রেকর্ড পরিমাণ কম বৃষ্টিপাত, আমন ফলন কমতে পারে ৪৫ লাখ টন

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২২ ২০:১৯; আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ২০:০২

ছবি: সংগৃহিত

আবহাওয়ার বিরুপ পরিস্থিতি ভোগান্তি বয়ে আনবে।৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে, ফলে আমন ফলন কমতে পারে ৪৫ লাখ টন। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল হওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা। খবর টিবিএসের।

দিনাজপুর সদর উপজেলার বড়ইল এলাকার একজন কৃষক মো. মিলন মিয়া। তিনি দুই বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছেন জুলাইয়ের শেষদিকে। সে সময় বৃষ্টি না থাকায় বিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়েছেন। আগস্ট মাসে কিছুটা বৃষ্টিপাত হলেও সেটা পর্যাপ্ত না হওয়ায়, ধানের চারাকে খরা থেকে বাঁচাতে তাকে নিয়মিতই পাম্প চালাতে হচ্ছে।

মিলন বলেন, 'আমনের ভালো ফলন করতে হলে সেচ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এরমধ্যে ডিজেল আর সারের দামও বেড়েছে'।

আকাশে মেঘের অবস্থাও খরাদগ্ধ ধানক্ষেতের জন্য বৃষ্টির আশা জাগাচ্ছে না।

মরুকরণ ও খরা দিবসকে সামনে রেখে গত ১৫ মে জাতিসংঘ তাদের 'গ্লোবাল ল্যান্ড আউটলুক' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এই প্রতিবেদনে, গত দুই বছর (২০২০-২২) ধরে খরার জরুরি অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে এমন ২৩টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তালিকায় অবশ্য বাংলাদেশের নাম নেই।

তারপরও পর্যাপ্ত ফলনের জন্য মৌসুমি বৃষ্টিনির্ভর বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের ভাগ্য এবার বদলাতে চলেছে।

খরার দহনে বিশ্ব এরমধ্যেই পুড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে পশু চড়ানোর জন্য কোনো ঘাস পাচ্ছে না সেনেগালের পশুপালকেরা; যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি রাজ্যে পানি সরবরাহ সীমিত করা হয়েছে; খরায় দগ্ধ হয়েছে চীন, ভারত ও পাকিস্তান। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত এই দুর্যোগের শীর্ষে বাংলাদেশও রয়েছে। ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ চক্রেও পড়ছে এই দুর্যোগের প্রভাব। তার আঁচটাও অনুভব করতে শুরু করেছে এ দেশের জনতা।

দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল, যার উৎপাদন চলতি আমন মওসুমে রেকর্ড কম বৃষ্টিপাত এবং চরম উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে ৪৫ লাখ টন কম হতে পারে।

জলবায়ুজনিত এসব কারণে, যে পরিমাণ জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার ৩০ শতাংশে এটি চাষ করা হয়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়, গত আমন মৌসুমে প্রায় দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এই বছর এক কোটি টন হলেও তা হবে সৌভাগ্যের বিষয়।

কৃষকরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের অভাবে তারা আমন চাষে পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দেওয়ার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে থেকেই ব্যয়বহুল এই উপায়ের খরচ আরও বেড়েছে ডিজেলের সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির ঘটনায়।

তার সঙ্গে, কৃষকদের কাঁধে বাড়তি চাপের বোঝা হয়ে চেপেছে সারের দাম বৃদ্ধি।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বলছে, এই বছর আমন চাষে সারাদেশে ৪ লাখেরও বেশি সেচ পাম্প ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে, যা একটি রেকর্ড।

বিএডিসির সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্রসেচ) ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ টিবিএসকে বলেন, 'এবারে রেকর্ড কম বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে সারাদেশেই কৃষকরা সেচ পাম্প ব্যবহার করছেন। আমন মৌসুমে এত পরিমাণ সেচ পাম্প ব্যবহার আগে হয়নি'।

কৃষিমন্ত্রী মো আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক অনুষ্ঠানে জানান, ডিজেল ও সারের বাড়তি দাম, ৪০-৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত এবং লোডশেডিং-সহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে এবারে আমনের আবাদ।

মন্ত্রী বলেছেন, বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে আগামী ১৫দিন সারাদেশের গ্রামাঞ্চলে অন্তত মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রদানের জন্য সরকার কাজ করছে, যাতে সেচ দিয়ে হলেও আমনটা চাষ করা যায়।

বৃষ্টিপাত কম হওয়ার প্রভাব, এরমধ্যেই কমতে থাকা ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের ওপরও বড় আঘাত হেনেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম বৃষ্টিপাতের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্ষা মৌসুমেও ব্যবহার করতে হচ্ছে এই উৎসটি। এই পরিস্থিতি, আগামী বোরো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে, কারণ বোরো শস্য পুরোপুরিই সেচের উপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) এর গ্রাউন্ড ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ টিবিএসকে বলেন, 'এবারের বর্ষায় কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যে কারণে ভূগর্ভস্থ পানির লেভেলটাও ঠিকমত রিচার্জ হচ্ছে না। এটা না হলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। তখন শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট দেখা দিতে পারে'।

বিএডিসি বলছে, প্রতি বছর বোরো চাষের জন্য শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র ব্যবহার হয়। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগের বেশি ডিজেলচালিত, বাকিগুলো বিদ্যুৎচালিত।
এবারে আমন মৌসুমেই ৪ লাখের বেশি সেচযন্ত্র ব্যবহার হওয়ায়, এটা শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সেচের পানির অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা বাড়তে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ চাহিদার তুলনায় চালের উৎপাদন ৩৬ লাখ টন কম হবে।

বর্তমানে দেশে সাড়ে তিন কোটি টন চালের চাহিদা রয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রক্ষেপণে দাবি করা হয়েছে, গত বোরো মৌসুমে ২.১১ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে এখনও উৎপাদনের চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হয়নি।

তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদারও সম্প্রতি বলেছেন, গত বোরো মৌসুমে চালের প্রকৃত উৎপাদন ২ কোটি টনের কম হতে পারে।

রেকর্ড কম বৃষ্টির প্রভাব

কৃষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির ঘটনায় তাদের ডিজেল ও সারের খরচ যথাক্রমে ৪২ ও ৩৭.৫ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) এর গবেষণা বলছে, প্রতি বিঘা জমিতে আমন ধান চাষে ২৩ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫৭.৬ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, যা ৪২ বছরের মধ্যে রেকর্ড।

অধিদপ্তরটির আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবদুল মান্নান টিবিএসকে বলেন, 'জুলাই মাসে ৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে। আগস্টেও (২৪ তারিখ পর্যন্ত) স্বাভাবিকের তুলনায় ৪৭ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে'।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আগস্টে স্বাভাবিকের তুলনায় ঢাকায় ৩৮%, ময়মনসিংহে ৩১%, চট্টগ্রামে ৫৮%, সিলেটে ৩৬%, রাজশাহীতে ৪৭%, রংপুরে ৬৬%, খুলনায় ৩২% এবং বরিশাল বিভাগে ১৮ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।

গবেষকরা জানান, ঢাকাসহ রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাটের মতো জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে (বোরো মৌসুম) এসব অঞ্চলে সেচের পানি পেতে বেগ পেতে হবে।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top