বাংলাদেশকে নিয়ে এখন বড় ছক আকঁছে আদানি গ্রুপ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৩; আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০১:১১

ফাইল ছবি

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ। বাংলাদেশের সংকট উত্তরনে এই গ্রুপের দারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশকে নিয়ে এখন বড় ছক আকঁছে গ্রুপটি। খবর বণিক বার্তার।

বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে ভারতের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপ। ভারতীয় কনগ্লোমারেটগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে আদানি গ্রুপেরই বাংলাদেশকেন্দ্রিক বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ভোজ্যতেল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বিদ্যমান বিনিয়োগের পাশাপাশি নতুন নতুন সম্ভাবনাও অনুসন্ধান করছে গ্রুপটি। আগ্রহ দেখিয়েছে খাদ্য, বন্দর অবকাঠামোসহ আরো নানা খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে ঘিরে বড় আকারে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে আদানি গ্রুপ।

এরই মধ্যে ভারতে সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন গৌতম আদানি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনায় বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়গুলো উঠে আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে এরই মধ্যে চলমান অন্য বিনিয়োগগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়গুলোয় একে অন্যের সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ, পরিবহন, লজিস্টিকস, বন্দর, এয়ারপোর্ট, রেল, ভোজ্যতেল, আবাসন, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে আদানি গ্রুপ। গতকালের তথ্যানুযায়ী গ্রুপটির বাজার মূলধন ২৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছেন গৌতম আদানি।

আদানি গ্রুপের বাংলাদেশকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এটি নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত হলেও এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই বাংলাদেশে রফতানি করা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চলমান ভারত সফরের সময় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউনিট-১-এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৬ ডিসেম্বর। আর দ্বিতীয় ইউনিটটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে আগামী বছরের ২৬ মার্চ।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ তুলনামূলক বেশি বলে সাম্প্রতিক কিছু পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এর জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন দি এক্সটার্নাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নেয়া না গেলে এর বিপরীতে বড় অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বাংলাদেশকে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ কোটি ৩২ লাখ ৯০ হাজার ডলারে।

দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। কোম্পানিটি রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেল বিক্রি করে। বিইওএল শতভাগ বিদেশী মালিকানাধীন যৌথ উদ্যোগ। সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও ভারতের আদানি গ্রুপ মিলে আদানি উইলমার নামে এ যৌথ উদ্যোগ গড়ে ওঠে। বিইওএলের যাত্রার সময় এতে আদানি উইলমারের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি ডলার।

চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ জোন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে আদানি গ্রুপ। এ প্রকল্পের উন্নয়নে গ্রুপটি ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আদানি গ্রুপ বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) প্রকল্পে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালি তুলে জমি ভরাটের কাজও করেছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আদানি গ্রুপের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটি। আবার খাদ্যপণ্যের ব্যবসায়ও আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে আদানি গ্রুপ। চাল প্রক্রিয়াজাত করে প্যাকেটজাত চাল বিক্রির পাশাপাশি রাইস ব্র্যান অয়েলের ব্যবসায়ও আসতে চায় তারা। বাংলাদেশে বন্দরের জেটি ও টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে আদানি গ্রুপ। আদানি গ্রুপের পরিকল্পনাধীন এসব প্রকল্পে সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ হতে পারে ২ বিলিয়ন ডলার।

মিরসরাইতে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ পেয়েছে আদানি গ্রুপ সেখানে অর্ধেক জমি আদানি গ্রুপ নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সংরক্ষিত রাখবে। বাকি অর্ধেক অন্যান্য ভারতীয় বিনিয়োগকারীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে। বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রকল্পটির বিস্তারিত তুলে ধরতে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ কিংবা ভারতে রোড শো আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গ্রুপের। সব মিলিয়ে এ খাতে ২-৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসতে পারে বলে গ্রুপটির ধারণা।

২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে আগের প্রতিশ্রুত অর্থের সঙ্গে নতুন করে আরো ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

আদানি গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তারা বাংলাদেশের যেসব খাতে ব্যবসার ভালো সুযোগ রয়েছে সেখানেই বিনিয়োগে আগ্রহী। এসব বিনিয়োগ পরিকল্পনার সম্ভাবনা যাচাইয়ে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশ সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। সবকিছু অনুকূল থাকলে এসব বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তব রূপলাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রুপটির নীতি হচ্ছে যেসব খাতের ব্যবসায় তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশে যদি সেসব খাতে ব্যবসার সুযোগ থাকে তাহলে তারা এতে আগ্রহী। তবে তারা ধীরে এগোতে চায়। একটি প্রকল্প সফলভাবে শেষ করার পর নতুন খাতে বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে এগোতে আগ্রহী আদানি গ্রুপ।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপ্তি বাড়ছে আদানির। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান ভারত সফরে আদানির নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে আদানি গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আদানি সাধারণত বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোয় কাজের আগ্রহ রাখে। এ ধরনের প্রকল্পের জন্য সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ফলে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্যও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক বিষয়ে সম্মত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সব মিলিয়ে আদানির বিনিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, বন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো বিনিয়োগের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে আদানি সম্পৃক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে এ মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়। এছাড়া আদানি উইলমারের মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগ সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আদানির বিনিয়োগের ব্যাপ্তি নিকট ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত হতে হবে। আদানির জন্য অর্থায়ন কোনো সমস্যা নয়। অর্থ জোগানের নিশ্চয়তা আমাদের আছে। সরকারের সহযোগিতায় সেই অর্থায়ন কাজে লাগিয়ে আমরা বিনিয়োগের ব্যাপ্তি বাড়াতে চাই।

বিনিয়োগের দিক থেকে শীর্ষে হলেও আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসা প্রথম প্রতিষ্ঠান নয়। এর আগেও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ ও ভারতী এয়ারটেল গ্রুপ এখানে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিপিডিবির সঙ্গে নির্মাণ ও ক্রয় চুক্তি করে ভারতীয় ব্যবসায়ী অনিল আম্বানির কোম্পানি রিলায়েন্স পাওয়ার। চলতি মাসে রিলায়েন্স মেঘনাঘাট ৭৫০ মেগাওয়াট আইপিপি-২ নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে আসার কথা। তবে বৈশ্বিকভাবে এলএলজির দাম আকাশচুম্বী হওয়ার কারণে বর্তমানে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। শিগগিরই এ সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব না হলে এটিকে বসিয়ে রাখতে হবে।

এছাড়া ভারতী এয়ারটেল দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তবে ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে বাংলাদেশে এয়ারটেলের ব্যবসা রবি আজিয়াটার সঙ্গে একীভূত করেছে ভারতী এয়ারটেল।

১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আদানি গ্রুপের ব্যবসা ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্তৃত রয়েছে। গ্রুপটির কর্ণধার গৌতম আদানি গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার র্যাংকিংয়ে স্পেসএক্সের ইলোন মাস্ক ও অ্যামাজনের জেফ বেজোসের পরেই বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনীর কাতারে উঠে এসেছেন।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top