চীন থেকে জ্বালানি তেল আমদানি: সুলভ না ভূরাজনীতি?

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২২ ২০:০০; আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৯

ছবি: সংগৃহিত

বিশ্বের অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লিপ্ত চীন ক্রমেই শিল্পোৎপাদন বাড়িয়ে তুলছে। ফলে সঙ্গে বাড়ছে দেশটির শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি ক্ষুধাও। খবর বণিক বার্তার।

এ চাহিদা নিবারণের জন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করছে দেশটি। হয়ে উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল আমদানিকারক। চীন নিজে আমদানিনির্ভর হলেও এ দেশই আবার বাংলাদেশে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি তেল (গ্যাসোলিন, ডিজেল, ফুয়েল অয়েল, কেরোসিন, লুব্রিক্যান্ট ইত্যাদি) আমদানির সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর একটি।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কভিডের প্রাদুর্ভাবে বাণিজ্য খাতে ভাটা পড়লেও ওই সময় দেশটি থেকে দেড় হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল বা পেট্রোলিয়াম আমদানি হয়েছে প্রায় ৭৭ কোটি ডলারের। সে সময় দেশে আমদানীকৃত পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের ২৯ শতাংশেরও বেশি এসেছে চীন থেকে। চলতি ২০২২ সালের আগস্টেও চীন থেকে পণ্য আমদানির তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে ছিল পরিশোধিত জ্বালানি তেল। এ সময় দেশটি থেকে ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানি করেছে বাংলাদেশ।

নিজেই আমদানিকারক হওয়ায় পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম রফতানিতে চীনের কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ বা তুলনামূলক সুবিধা তেমন একটা নেই। ওইসি ছাড়াও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের নানা গবেষণায় ও পর্যবেক্ষণেও বিষয়টি উঠে এসেছে। চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণভিত্তিক একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন নানজিংভিত্তিক হোহাই ইউনিভার্সিটি এবং জিয়াংশি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নরমাল ইউনিভার্সিটির চার গবেষক। ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তাদের গবেষণায় বলা হয়, আরসিএ মান (রিভিলড কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ বা প্রত্যক্ষ তুলনামূলক সুবিধা) বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম বাণিজ্য থেকে বাংলাদেশ বা চীন কেউই তেমন কোনো সুবিধা নিতে পারছে না। এ আড়াই দশকে দুই দেশের জন্যই জ্বালানি বাণিজ্যে আরসিএ মান ছিল ১-এর নিচে। ‘ট্রেড ইন্টেনসিটি অ্যান্ড রিভিলড কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ: এন এমপিরিক্যাল অ্যানালাইসিস অব ট্রেড বিটুইন চায়না অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে তাদের এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে।

প্রসঙ্গত, আরসিএ হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি নির্দিষ্ট দেশের কোনো নির্দিষ্ট পণ্য আমদানি বা রফতানির তুলনামূলক সুবিধার পরিমাপক। এক্ষেত্রে আরসিএ মান ১-এর কম হওয়ার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট দেশটি থেকে উল্লিখিত পণ্য আমদানি বা রফতানিতে তুলনামূলক সুবিধা পাওয়া যায় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কম।

এ অবস্থায় চীন থেকে বড় মাত্রায় পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে নির্ভরতার পেছনে বাণিজ্যিক সুবিধার চেয়ে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিকগুলো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম রফতানিতে তুলনামূলক সুবিধার জায়গা থেকে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চীনের ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীলতা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে চীন থেকে। অথচ বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশই প্রায় একই উৎস থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।

আমদানিনির্ভর হওয়ায় জ্বালানি রফতানির সক্ষমতায় চীনের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন দেশটির বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জিমিংও। কিছুদিন আগেই ঢাকায় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, চীন নিজেই এলএনজিসহ নানা ধরনের জ্বালানি পণ্য আমদানি করে। তাই এসব জ্বালানি পণ্য রফতানি করার মতো অবস্থা চীনের নেই।

একই অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট তীব্রতা পেলে তার দেশ চুপচাপ বসে থাকবে না। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে বেইজিং। সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়টি বেইজিংকে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এতটা জোরালোভাবে সহায়তার কথা জানায়নি চীন। যদিও দেশটিতে সংকটের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। আবার কলম্বোর সঙ্গে চীনের বেশ সখ্যতাও তৈরি হয়েছিল। তৎকালীন রাজাপাকসে সরকারের সময়ে দেশটিতে একের পর এক বৃহদায়তনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি রাজাপাকসেরাও প্রত্যক্ষ আনুকূল্যে দেশটিতে চীনের আধিপত্যও দিনে দিনে বেড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের সংকটে চীনের দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার পেছনে ভূরাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিবেচনাও কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো বিষয়ের পেছনেই একটা ভৌগোলিক বা অন্য কোনো কূটনৈতিক চিন্তা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে সহজলভ্যতা বা মূল্য সুবিধারও বড় একটি ভূমিকা থাকতে পারে। আর কৌশলগতভাবে আমাদের সুবিধা নেয়ার সুযোগ থাকলে, আমরা তো চাইবই তা ধরে রাখতে। আর শ্রীলংকার ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। তারা তো এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে চীনেরও এক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল অবস্থান থাকা স্বাভাবিক।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিনে দিনে ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠেছে। ১৯৯৫ সালেও দেশটি থেকে ৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালের মধ্যে তা দেড় হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এ ২৫ বছরে চীন থেকে বাংলাদেশের বার্ষিক পণ্য আমদানি বেড়েছে গড়ে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। দেশটি থেকে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম ছাড়াও নানা ধরনের সুতা, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল, কাগজ, সারসহ নানা ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। এছাড়া এখন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর, বয়লার, মেশিনারিসহ বিভিন্ন মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।

দেশে জ্বালানি তেল আমদানিতে নিয়োজিত একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) পরিশোধনাগারে পরিশোধনের পর রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে তা বিপণন করা হয়। বিপিসি ও ইআরএলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৫৫-৬০ লাখ টন। অন্যদিকে ইআরএলের একমাত্র ইউনিটটির জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। বর্তমানে এ সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৯৬-৯৭ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। চাহিদার বাকিটুকু পূরণের জন্য আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, যার বড় একটি উৎস এখন চীন। সার্বিক বিষয়ে জানতে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় চলমান রিজার্ভ পরিস্থিতিকে বড় একটি অসুবিধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় করে আমদানি বহাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। তবে এ মুহূর্তে চীনের সঙ্গে দেশটির স্থানীয় মুদ্রা রেনমিনবিতে (ইউয়ান) বাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে। সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোয় জ্বালানিসহ দেশের আমদানিনির্ভর খাতগুলোয় চীনের আরো প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আমদানি ও রফতানিতে চীনা রেনমিনবিতে লেনদেন করতে তফসিলি (এডি) ব্যাংকগুলো হিসাব খুলতে পারবে। এজন্য দেশী ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ইউয়ান সংগ্রহ করতে পারবে। এর আগে ২০১৮ সালেই এক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে চীনা মুদ্রায় লেনদেনের পথ খুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সে সুবিধার ব্যাপ্তি আরো বেড়েছে।

চীনা মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ বাড়ার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও চীনের পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, যেহেতু চীন নিজেই জ্বালানি তেলের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু দেশটি থেকে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানিতে আরসিএ ভ্যালু ভালো হওয়ার কথা না। তবে দেশটির জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আমদানীকৃত জ্বালানি তেল পরিশোধনের পর চাহিদার অতিরিক্ত যা উদ্বৃত্ত থাকে, সেটিই রফতানি করে দেশটি। চীনের টেন্ডারদাতারা কম মূল্যে সরবরাহের ঘোষণা দিয়ে কাজ পেতেই পারেন। এছাড়া এখন দেশটি রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। সে হিসেবে সামনের দিনগুলোয় দেশটির পরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানির সক্ষমতা আরো বাড়তে যাচ্ছে।

লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top