সড়ক আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত: উপেক্ষিত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ দাবি

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২২ ২০:০৩; আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১১:০০

ছবি: সংগৃহিত

দেশের সড়ক বিভাগে সামগ্রিক নিরাপত্তার দাবিতে ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করাসহ নয় দফা দাবিতে ২০১৮ সালের জুলাই-আগস্টে দেশজুড়ে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে এসব দাবি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। খবর বণিক বার্তার।

আন্দোলনের মুখে শিক্ষার্থীদের প্রায় সব দাবি মেনে নেয় সরকার। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই পাস করা হয় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। একই সময়ে দেশের সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো ও নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগও নেয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন দেশের সড়ক পরিবহন খাতের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই সময় সুযোগ এসেছিল একটি সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার। কিন্তু যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়ক নিরাপত্তা এখনো উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত করে এনেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের পর বিধিমালাটি এখন ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে। তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র আন্দোলনের পর নিরাপদ সড়কের জন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিধিমালা কার্যকরের পরও সড়ক পরিবহন আইনটি খুব একটা কাজে আসবে না।

অন্যদিকে বিধিমালা কার্যকরের পর বাড়বে মোটরযান ব্যবহার ব্যয়। বর্তমানে একটি মোটরযান রাস্তায় চালানোর জন্য সেটির নিবন্ধন, আয়কর, রুট পারমিট ও হালনাগাদ ফিটনেস সনদের জন্য নির্ধারিত হারে ফি দিতে হয়। সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য একটি সহায়তা তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিধিমালার মাধ্যমে এ তহবিলে বার্ষিক ও এককালীন চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দিতে হবে মোটরযান মালিকদের।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের এক নম্বর দাবি ছিল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। যদিও আইনটির সংশোধনীতে জরিমানার পরিমাণ ৫ লাখ থেকে কমিয়ে ৩ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির অন্যতম ছিল ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা। আন্দোলনের চার বছর পরও এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। এখনো সড়কে অবাধে চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে দেশে আনফিট মোটরযানের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি।

অবৈধ চালকের হিসাব দিয়ে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ৩৫ লাখ মোটরযানের বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার। পরের চার বছরে দেশে মোটরযানের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫৫ লাখে উন্নীত হলেও চালকের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো দেশে যত মোটরযান রয়েছে, তার বিপরীতে বৈধ চালক অর্ধেকেরও কম।

ছাত্র আন্দোলনের পর পাস করা সড়ক পরিবহন আইনে লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান চালানোর শাস্তি ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন আইনটির সংশোধনীতে এ জরিমানা ১৫ হাজারে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আরেকটি দাবি ছিল বাসে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ করা। আন্দোলনের পর কিছুদিন ঢাকায় চলাচলরত বাসগুলোয় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করতে দরজা বন্ধ রাখার নিয়ম চালু হয়েছিল। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আবারো পুরনো নিয়মে ফিরে যায় সব বাস।

শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অর্ধেক ভাড়া’ বাদে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের আর কোনো দাবিই দৃশ্যত বাস্তবায়ন হয়নি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর পরিবহন ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এর মধ্যে যাত্রার সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখা, যত্রতত্র যাত্রী না তোলা, মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযানসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বর্তমানে মোটরসাইকেলে চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহার ছাড়া আর কোনো উদ্যোগই কার্যকর নেই।

অন্যদিকে ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করে তোলা, বাস স্টপেজ তৈরি, অবৈধ পার্কিং প্রতিরোধ, ট্রাফিক সিগন্যালের উন্নয়নসহ স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। একইভাবে আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সড়ক নিরাপত্তায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। এমনকি ‘সড়ক ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা হ্রাস’ কমিটির ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত টাস্কফোর্সও এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

এ অবস্থায় বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনটি সড়ক নিরাপত্তা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সমাজের নৈতিকতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষ আশাবাদী হয়েছিল, এবার সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। সরকারের সংস্থাগুলোও আশার বাণী শুনিয়েছিল। পুলিশের তরফ থেকে কতগুলো কমিটমেন্ট এসেছিল। সুশৃঙ্খলভাবে বাস পরিচালনার জন্য পরীক্ষামূলক করিডোর হিসেবে ঢাকার ভিআইপি রোডকে বেছে নেয়া হয়েছিল। মালিকরা বলেছিলেন গাড়ির ফিটনেস, দরজা বন্ধ রাখা, লিজ বন্ধ করার মতো বিষয়গুলো তারা দেখভাল করবেন। বিআরটিএ থেকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ, পরিবহন মালিক, বিআরটিএ কেউই তাদের কথা রাখতে পারেনি।

তিনি আরো বলেন, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনায় অবকাঠামো গড়ে তোলা। এরপর প্রয়োজন সড়ক ব্যবহারকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা। সবার শেষে প্রয়োজন আইনের শাসন। প্রথম ও দ্বিতীয়টি বাদ দিয়ে শুধু আইন প্রয়োগ করে কোনোভাবেই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।

যদিও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইউছুব আলী মোল্লা বলছেন, বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ শুরু হবে। আর আইনটির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। বিধিমালার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিধিমালাটি অনুমোদিত হয়েছে। এরপর সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের অনুমোদনের পর বিধিমালা কার্যকরের এসআরও জারি করা হবে।

বণিক বার্তার খবরটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top