ছোট হয়ে আসছে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২২ ২০:১৩; আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ২২:৫৫

ছবি: সংগৃহিত

দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশে মোট পণ্য আমদানি-রফতানির ৯৩ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এ বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেয়ায় প্রবৃদ্ধিও গড়ে ১০ শতাংশের মতো। গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরটির যখন এগিয়ে যাওয়ার দিকে, খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ছোট হচ্ছে বন্দরের তহবিলের আকার। খবর বণিক বার্তার।

ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধার কাজ এগিয়ে চলায়, শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বেড়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতসহ লজিস্টিক সেবার মানোন্নয়নে নিজস্ব অর্থায়নের শক্তিশালী সক্ষমতা থাকা জরুরি। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনায় উঠে এসেছে উল্টো চিত্র। গত দুই বছরে বেশ ছোট হয়ে এসেছে ব্যস্ততার দিক থেকে বিশ্বের ৬৪তম ও দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরের তহবিলের আকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তহবিল কমে গেলে ভবিষ্যতের বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ মোকাবেলা করে উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করা যাবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

সম্প্রতি মোট চার ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক স্থিতি (ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ) চাওয়া হয়েছে। এর পাশাপশি সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়নে চলমান ও আগামী তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকাও (বছরভিত্তিক সম্ভাব্য ব্যয়সহ) প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে দ্রুত জমা দিতে বলা হয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী লুতফুল হাসান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বন্দরের গত পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী এবং পেনশন ও ভবিষ্য তহবিলে রক্ষিত অর্থের আলাদা হিসাব বিবরণী দিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য সংস্থার তহবিলে জমা থাকা উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে চলমান ও আগামী তিন বছরে বাস্তবায়নযোগ্য অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। এর আগেও একই প্রক্রিয়ায় ফান্ডের স্থিতি জেনে অর্থ মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কয়েক ধাপে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিলে থাকা অর্থ সরকারের অনুকূলে নেয়া হয়। সে সময়ে এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বন্দর-সম্পর্কিত বিভিন্ন পক্ষ থেকে লিখিতভাবে ক্ষোভ জানানো হয়। তাদের যুক্তি ছিল, এ পদক্ষেপের ফলে বন্দরের তহবিল দুর্বল হয়ে যাবে, উন্নয়ন প্রকল্প, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ বিভিন্ন খাতে ঝুঁকি তৈরি হবে। গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প হাতে রেখে ফান্ড থেকে টাকা নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিলে ৬ হাজার ১৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা রয়েছে। মোট ৪৯৫টি এফডিআরের মাধ্যমে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখা আছে এ অর্থ। মূলত জাহাজ ভেড়ানো, পণ্য ওঠানামা, ইয়ার্ড ভাড়া এবং নিজস্ব জমি ভাড়াসহ বিভিন্ন খাত থেকে প্রতি বছর এ অর্থ আয় করে বন্দর। আবার এ তহবিল থেকেই মূলত বন্দরের চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এছাড়া পরিচালন কার্যক্রমের জন্য যন্ত্রপাতি, জনবল ও অপারেশনাল ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় এ তহবিলের অর্থে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর-সম্পর্কিত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিলে পেনশন বাদে ৮ হাজার কোটি টাকা জমা ছিল। মোট ৪২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর, সঞ্চয়ী আমানত এবং বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের চলতি হিসাবে এ টাকা ছিল। দেশের অন্য কোনো সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এভাবে অর্থ জমা থাকার নজির নেই।

গত দুই বছরে বন্দরের আয় বেড়েছে, কিন্তু ছোট হয়েছে নিজস্ব তহবিলের আকার। কারণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি কোষাগারে কয়েক দফায় অর্থ প্রদান করতে হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে। এর মধ্যে ৪৬০ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে। অবশ্য পায়রার অনুকূলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড় নিয়েও সেই সময় বেশ সমালোচনা হয়। জাইকার একটি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও ভবিষ্যতে খুবই সীমিত পরিসরে ব্যবহার হবে পায়রা বন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বণিক বার্তাকে বলেন, বন্দরের কাছে নিজস্ব শক্তিশালী তহবিল থাকলে ভালো। সামনে পতেঙ্গা টার্মিনাল চালু হবে, বে টার্মিনাল নির্মাণ হবে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে আরো প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক যে সরকারের প্রয়োজন হলে বন্দরের তহবিল থেকে সরকার অর্থ নেবে। বন্দরও প্রয়োজন পড়লে সরকারের কাছে অর্থ চাইবে। এরই মধ্যে বন্দরের হালনাগাদ ফান্ড ও আগামী তিন বছরের ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিংয়ের বিষয়ে জানতে চেয়ে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা শিগগিরই এর উত্তর পাঠাব।

এর আগে জাইকার এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছিল, ২০২৬ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হবে ৩৪ লাখ ৯ হাজার একক। যদিও ২০২১ সালেই কনটেইনার পরিবহন ৩২ লাখ একক ছাড়িয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়তে থাকায় এককভাবে চাপও বাড়ছে এ বন্দরের ওপর। জাইকার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৯ লাখ এককে। ওই সময় মাতারবাড়ীর মাধ্যমে ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৯৯ টিইইউএস ও পায়রার মাধ্যমে মাত্র ৫ লাখ ৪৬ হাজার ২২৮ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, তেল শোধনাগার, জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সময়মতো অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ায় বছরের স্বাভাবিক সময়ে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের চাপ নিতে হিমশিম খেতে হয় বন্দরকে। জাহাজজট সৃষ্টি হয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে ব্যয় বাড়ে ব্যবসায়ীদের।

বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কস্ট বেজড ট্যারিফে চলে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি সরাসরি সম্পর্কিত। এমনিতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে বন্দরের সক্ষমতা না বাড়ানোর অভিযোগ অনেক পুরনো। তাই বন্দরের নিজস্ব অর্থায়ন সক্ষমতা কমে এলে এ বন্দর যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি আমদানি-রফতানিতে যুক্ত ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়বেন। প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকলে সেবাদানকারী সংস্থা হয়েও অপারেশনাল চার্জ বাড়িয়ে দেয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে বে টার্মিনাল দ্রুত নির্মাণের মতো বন্দর সম্প্রসারণের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে কীভাবে সেন্টার অব এক্সিলেন্স বানানো যায়, এখন সেটি নিয়েই সবাইকে কাজ করতে হবে।

বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হুসাইন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও আমি মনে করি আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে চলতে দেয়া উচিত। নতুবা গভর্ন্যান্স কমপ্লায়েন্স ডেভেলপ করবে না। সংস্থাটির সামনে যখন কোনো যৌক্তিক ব্যয় আসবে যেন নিজস্ব অর্থায়নেই সেটি নির্বাহ করতে পারে এটাই হওয়া উচিত। না হলে এমনও সময় আসতে পারে যেখানে নিজস্ব অর্থায়ন ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে প্রয়োজনের সময় জরুরি প্রকল্পও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। এমনকি খুব বড় নয় এমন প্রকল্পের জন্যও অর্থায়ন পেতে বিদেশী বিনিয়োগ খুঁজতে হবে।

লয়েডস লিস্টের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩২ লাখ ১৪ হাজার একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। বন্দরের মূল স্থাপনা, কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল মিলিয়ে এ হিসাব ধরা হয়েছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার একক কনটেইনার। এ হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যত পণ্য পরিবহন হয় তার ২৭ শতাংশ কনটেইনারে আনা-নেয়া হয়। কনটেইনারে বেশির ভাগ আমদানি হয় শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও ভোগ্যপণ্য। বাকি ৭৩ শতাংশই আনা-নেয়া হয় কনটেইনারবিহীন সাধারণ জাহাজে। সাধারণ জাহাজের মধ্যে যেমন বাল্ক, ব্রেক বাল্ক ও ট্যাংকারের খোলে মূলত আমদানি হয় সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক কারখানার কাঁচামাল এবং পাথর, কয়লা, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল। অন্যদিকে সমুদ্রপথে রফতানির পুরোটাই যায় কনটেইনারে। ফলে পণ্য পরিবহনের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোতে অর্থায়ন সময়মতো করা না গেলে এর ছাপ পড়বে সরাসরি বৈদেশিক বাণিজ্যে।

বণিক বার্তার খবরটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top