অর্থনৈতিক চাপের মুখে জাপান, বন্ধ হবে কি ওডিএ ঋণ কর্মসূচী?

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২২ ২০:৪১; আপডেট: ৬ মে ২০২৪ ১৯:২৮

ছবি: সংগৃহিত

জাপানি মুদ্রা ইয়েনের অবমূল্যায়নে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে আছে জাপান। ফলে বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার (ওডিএ) ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। জাপানের ওডিএ ঋণের অন্যতম গ্রহীতা বাংলাদেশ। খবর বণিক বার্তার।

‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বির আওতায় বাংলাদেশকে গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ ঋণসহায়তা দিয়েছে জাপান। আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার (ওডিএ) হিসেবে পাওয়া এ ঋণের অর্থ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মতো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশে।

ওডিএর আওতায় বিভিন্ন দেশে ঋণসহায়তা দেয়াকে কূটনীতি ও ভূরাজনীতির বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে টোকিও। এটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে গত কয়েক দশকে সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা দাতা দেশ হয়ে উঠেছে জাপান। কিন্তু বর্তমানে দেশটির এ সহযোগিতা কার্যক্রম নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি করেছে জাপানি ইয়েনের অবমূল্যায়ন।


ইয়েনের ক্রমাগত অবমূল্যায়ন হওয়ায় ডলারে ঋণ দিতে গিয়ে বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে জাপান। এ অবস্থায় টোকিওর কূটনৈতিক মহলে ঋণ ও সহায়তাগ্রহীতা দেশগুলোর সঙ্গে জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সম্প্রতি জাপান টাইমসকে জানিয়েছেন, ঋণগ্রহীতা দেশগুলোয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উপকরণ ক্রয় ও স্থানীয় পর্যায়ে শ্রমিক নিয়োগের জন্য ডলারের জোগান দেয়া দেশটির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক শ্লথতা দেশটির সরকারের জন্য এরই মধ্যে বড় ধরনের চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় দেশে দেশে জাপানের ওডিএ ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে গৃহীত বিগ-বি উদ্যোগের গতি শ্লথ হয়ে আসারও আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।

বিগ-বি উদ্যোগটি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময়ে। ওই সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ শিনজো আবে। সে সময় বাংলাদেশে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ৬০ হাজার কোটি ইয়েন (তৎকালীন বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৬০০ কোটি ডলার) বিনিয়োগের ঘোষণা দেন শিনজো আবে। এর বেশির ভাগই ওডিএ ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করার কথা। বিগ-বি উদ্যোগের আওতায় এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের ঘোষণা সে সময় ভূরাজনীতির দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করে।

এর চার মাসের মাথায় সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসেন শিনজো আবে। ওই সফর চলাকালেও শিনজো আবে অর্থনৈতিক অবকাঠামো, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নে জাপানের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে জাপান নিয়মিতভাবে এ সহযোগিতা বাস্তবায়ন করে যাবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

স্বাধীনতার পর থেকেই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান। মূলত জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে ওডিএ ঋণ বিতরণসহ নানা উন্নয়ন সহযোগিতা করে আসছে টোকিও। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জাপানের কাছ থেকে ঋণ, অনুদানসহ বিভিন্নভাবে মোট সহায়তা পাওয়া গিয়েছে ২ হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো, পরিবেশ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। বিশেষ করে গত এক দশকে বাংলাদেশে দেশটির ওডিএ ঋণ প্রতিশ্রুতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে জাইকার বৈশ্বিক ঋণ প্রতিশ্রুতির গন্তব্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জাইকার মোট বৈশ্বিক ঋণ প্রতিশ্রুতির ২৬ দশমিক ৮ শতাংশেরই গন্তব্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরেও দেশটির কাছ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছে প্রায় ১৭৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। অন্যান্য উন্নয়ন-সহযোগীর তুলনায় বেশ শিথিল শর্তেই বাংলাদেশকে ঋণ দেয় জাপান। এসব ঋণের সুদহার কম। আবার পরিশোধের সময়সীমা ও এর অতিরিক্ত গ্রেস পিরিয়ডও বেশি।

মূলত শিনজো আবের বিগ-বি ঘোষণার ভিত্তিতেই গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে জাপানি বিনিয়োগ বেড়েছে। বর্তমানে জাপান নিজেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্গতির ঢেউ আঘাত হেনেছে জাপানেও। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক শ্লথতা মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার। গত সপ্তাহেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নতুন করে প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছেন। এছাড়া নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ কোটি ইয়েনের সমপরিমাণ ঋণপত্র ইস্যুরও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। আবার জাপানের বর্তমান কিশিদা সরকার শিনজো আবের আমলের অনেক কর্মসূচি থেকেই বেরিয়ে আসছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনের দিনগুলোয় জাপান থেকে বিভিন্ন দেশে ঋণ ও অনুদান হিসেবে অর্থসহায়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।

যদিও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, অন্য অনেক দেশের উন্নয়ন খাতে জাপানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশের সঙ্গে জাপানের মৈত্রিতা সবচেয়ে বেশি দৃঢ়, তার একটি হলো বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর দ্রুত স্বীকৃতি দেয়া থেকে শুরু করে এখনকার দ্বিপক্ষীয় ও ব্যক্তি খাতে জাপানি বিনিয়োগ পর্যন্ত সবদিকেই এ মৈত্রীর ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব আরো অনেক বেড়েছে। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক সংযোগস্থলে অবস্থানের পাশাপাশি এখানকার বাজারও বেশ বড়। আঞ্চলিক গেটওয়ে হিসেবে মিয়ানমার একসময় বড় সম্ভাবনা দেখালেও সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটির যাবতীয় বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে প্রায় বিনষ্ট করে দিয়েছে। বরং দুই উপ-অঞ্চলের (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) ‘গেটওয়ে মার্কেট’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ অবস্থায় জাপান কোনোভাবেই চাইবে না বাংলাদেশে বিনিয়োগ হ্রাস করে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে। সে হিসেবে সামনের দিনগুলোয় বিগ-বির আওতায় বিনিয়োগ বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ্-আল-মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ভবিষ্যতের কথা বলা যাচ্ছে না। তবে আমাদের দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ এ মুহূর্তে দেখছি না। বরং প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাপান সফরকে কেন্দ্র করে বেশকিছু আশার দিক রয়েছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর কথা শোনা যাচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে সংকট নয়; বরং সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। কারণ ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশগুলোয় এখন শিল্প উৎপাদনে শ্রম ও বিদ্যুৎ ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে জাপানের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ সময়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে বরং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরো জোরালো ও ত্বরান্বিত হবে।

অনেকটা একই বক্তব্য জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল মো. আনোয়ার শহীদেরও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কোনো প্রভাব জাপান-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্কে পড়বে না। জাপান চায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে থাকুক। অভিন্ন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় জাপান বাংলাদেশকে সঙ্গে রাখতে চায়। আমরা যদি আমাদের যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারি এবং জাপানের দেয়া ঋণগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারি, দেশটি আমাদের অবারিত সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে।

বিগ-বির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাইকার ভাষ্য হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বেল্ট ও অন্যান্য এলাকায় শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি এখানে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি এবং কানেক্টিভিটি বাড়াতে বিগ-বি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। মূলত তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিগ-বি। এর প্রথমটি হলো শিল্প ও বাণিজ্য। এ স্তম্ভের অংশ হিসেবে বর্তমানে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হচ্ছে, যাতে অর্থায়ন করছে জাইকা। নির্মাণ শেষে বন্দরটি বাংলাদেশকে এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে বৃহৎ বাণিজ্যিক গেটওয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে জ্বালানি খাতকে। এ বিষয়ে জাইকার বক্তব্য হলো বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমে মাতারবাড়ী দ্বীপকে কয়লা, এলএনজি ও জ্বালানি তেলের মতো প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব উত্স ব্যবহার করে উৎপাদনকৃত বিদ্যুৎ শুধু শিল্প ও বাণিজ্য বা বিগ-বির আওতাধীন এলাকাগুলো নয়, বরং গোটা বাংলাদেশকেই লাভবান করবে।

পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে বিগ-বি উদ্যোগের তৃতীয় স্তম্ভ হিসেবে দেখছে জাইকা। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানির উৎপাদন বাড়াতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও সংযুক্ত করা উচিত। শিল্প খাতকে আরো সক্রিয়ভাবে বিকশিত করতে জাতীয় মহাসড়ক ও রেলপথের বিকাশ ও উন্নয়ন জরুরি। দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভূমিকা জাইকাকে বিষয়টি নিয়ে আরো উত্সাহিত করে তুলেছে।

জাপানের বিনিয়োগগুলোকে বাংলাদেশের উন্নতির সুযোগ হিসেবে দেখছেন জেবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এবং হক’স বে অটোমোবাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিগ-বি হলো বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক সংযোগ তৈরির ধারণা। এ ধারণার অর্থ হলো অবকাঠামো ও শিল্পায়নকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে আমরা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ও বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আরো জোরালোভাবে সংযুক্ত হতে পারি। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য বস্তুতপক্ষে উন্নতির সোপানে ওঠার বড় একটি সুযোগ। জাপানিরা সাধারণত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তারা সেটি যেকোনো পরিস্থিতিতে পূরণ করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জাপানকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন। জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেও বাংলাদেশকে দারুণভাবে সহায়তা করেছেন। এমনকি হোলি আর্টিজানের ঘটনার পরেও শিনজো আবে বাংলাদেশকে যথেষ্ট সহায়তা দিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের আইকনিক কিছু প্রকল্প এখন তাদের সহায়তায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে সুপার আল্ট্রা প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সঙ্গে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে। যেটি ২৫-৩০ বছর আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দরের চাহিদা মেটাবে।

বিগ-বির আওতায় গৃহীত কর্মসূচিগুলো অর্থনৈতিক হলেও এর লক্ষ্যগুলো পুরোদস্তুর ভূরাজনৈতিক বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিগ-বি ঘোষণার আগের বছর ২০১৩ সালে প্রথম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ঘোষণা দিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আগ্রাসী ও উচ্চাভিলাষী এ পরিকল্পনা সে সময় বেইজিংয়ের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সতর্ক করে তুলেছিল। তাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল উদ্যোগটির সফল বাস্তবায়ন শুধু এশিয়া-প্যাসিফিক নয়, গোটা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেই চীনকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলবে। এ অবস্থায় ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাবকে ঠেকাতে একের পর এক কর্মসূচি নিতে থাকে তারা। বিগ-বি উদ্যোগটিকেও তেমনই এক কর্মসূচি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনৈতিক সংকট যেমনই হোক না কেন, ভূরাজনৈতিক কারণেই জাপান বাংলাদেশকে সহায়তা করা অব্যাহত রাখবে বলে মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিগ-বি এর দুটো অংশ রয়েছে। একটি অর্থনৈতিক, আরেকটি কৌশলগত। চীন সে অবস্থান দখল করার আগে দীর্ঘদিন জাপান ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এ কারণে তাদের বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করার সক্ষমতা বরাবরই বেশি ছিল। মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেরই বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা হচ্ছে জাপান। এখনো তাদের সহায়তা করার সক্ষমতা আছে। চাপ থাকলেও জাপানের অর্থনীতির যে সক্ষমতা রয়েছে, বড় পরিসরে না হলেও ছোট পরিসরে সহায়তা অব্যাহত রাখা সম্ভব। দেশটি এখন প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত সক্ষমতা বাড়াতে খুব সক্রিয়। চীনের উত্থানের মধ্য দিয়ে জাপানের ভূমিকাও ত্বরান্বিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে জাপানকে কৌশলগত সক্ষমতা বাড়াতে উত্সাহিত করছে। এখনো করে যাচ্ছে। কোয়াড দুই বছর ধরে সক্রিয় হওয়ার কারণে জাপানের সক্ষমতার গতি আরো বেড়েছে। এখানে জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনীতির পাশাপাশি চীনের মতো কৌশলগত দিকগুলোয়ও সমান নজর দিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ থেকে (টিপিটি) বের হয়ে যাওয়ার পর জোটটির ১১ দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন জাপান। দেশটির নেতৃত্বে ওই পুরনো টিপিপি জোটই নতুন করে কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিটি) নামে সংগঠিত হয়েছে। এখনো ইন্দোপ্যাসিফিকের ভূরাজনীতিতে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সমর্থন রয়েছে। এখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কিছু পরিবর্তন এলেও আমার ধারণা কিশিদা সরকারও পররাষ্ট্রনীতি এবং কৌশলগত দিক থেকে আবে সরকারের অবস্থানকে ধরে রাখবে।

বণিক বার্তার প্রতিবেতনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top