এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৪ ১৮:১৭; আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪ ০৮:৪৭

ছবি: সংগৃহীত

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যু ঘিরে চলছে নানা আলোচনা। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।

বুধবার (২২ মে) ধানমন্ডির বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এমপি আনার খুনের ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে।

এর আগে এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধার নিয়ে কথা বলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। কোনো নিশ্চিত তথ্য না থাকায় তারা তখন বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

জানা গেছে ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার (২২ মে) কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম টিভি নাইন বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১২ মে কলকাতায় যান আজিম। একজন অফিসারের ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন। বরানগর এলাকার সিঁথিতে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আজিম তার নাম গোপাল বিশ্বাস।

গত ১৩ মে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাড়া করা গাড়িতে ওঠেন আজিম। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পুলিশের প্রাথমিক অনুমান সংসদ সদস্য আজিমকে খুন করা হয়েছে। তবে পুলিশ এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে মুখ খুলছে না।

সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কারা আজিমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তার এ তদন্তে কাজ করছে বিধাননগর পুলিশ কমিশনার, আইবি ও এসটিএফ।

পশ্চিম বঙ্গের সংবাদ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে চিকিৎসা করাতে এসে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম। গত ৮ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর নিউটাউন থেকে মরদেহ উদ্ধার হয়। আওয়ামী লীগের ৩ বারের এমপি ছিলেন আজিম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল শুরু হয়েছে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে। কে বা কারা তাকে খুন করেছে তার তদন্তে নেমেছে দেশটির পুলিশ প্রসাশন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঝিনাইদহের এমপি যথাযথভাবে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পর তার কোনো খোঁজখবর পাচ্ছি না। সরকারের সব এজেন্সি এটা নিয়ে কাজ করছে। এনএসআই, এসবি, পুলিশ কাজ করছে। ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ চলছে। আমার কাছে এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। যতটুকু শুনেছি, তার মোবাইল ফোনটা বন্ধ আছে।’

চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে গত ১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। পরদিন ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফের সঙ্গে তার কথা হয়। গত ১৬ মে সকাল ৭টা ৪৬ মিনিটে এমপির ফোন থেকে পিএসের নম্বরে সর্বশেষ কল আসে। কলটি ধরতে পারেননি পিএস। এক মিনিট পর পিএস তাকে কল করলে ওপাশ থেকে রিসিভ হয়নি। এরপর থেকে আনারের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই পরিবারের সদস্যদের।

জানা গেছে, এক সময় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন আনার। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৬ সালে ইন্টারপোলের তালিকায় তার নাম ওঠে। ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার হওয়ার পর এলাকায় ফিরে আগের মতোই কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি।

আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান।

আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার।

ঝিনাইদহের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী।

ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা।

১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো।

কথিত আছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আনার। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল।

সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয় যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর দশ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top