খসড়া আইন অনুমোদন

দণ্ডিত ব্যক্তি সিইসি-ইসি হতে পারবেন

ডেক্স রির্পোট | প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারী ২০২২ ০৮:৫৬; আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৪ ১৫:০৬

ফাইল ছবি

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে শেষ পর্যন্ত আইন প্রণয়নের পথেই হাঁটছে সরকার। এ সংক্রান্ত আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

প্রস্তাবিত আইনের এই খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে তার একাধিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে দণ্ডিত ব্যক্তিও নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনার পদে নিয়োগ পেতে পারবেন। আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুবছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না। এর অর্থ দাঁড়ায় দুই বছরের কম দণ্ডিত ব্যক্তিরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনার হতে পারবেন।

সূত্র: যুগান্তর।

‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় সাত মাস পর সরকারপ্রধানের সরাসরি উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার বৈঠক ছিল এটি। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তবে সংবিধানের ১১৮(১) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এবার ৫০ বছর পর কোনো সরকার ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিল।

খসড়া আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচনি আইন-কানুন বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এমন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দণ্ডিত অর্থাৎ অপরাধ প্রমাণিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইনে বিগত সব নির্বাচন কমিশনকে হেফাজত করা হচ্ছে। কিন্তু গত দুটি নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরাট ক্ষতি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এই বিষয়টিও গ্রহণযাগ্য নয়। বদিউল আলম আরও বলেন, অনুসন্ধান কমিটি কাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করল। কাদের নাম সুপারিশ করল তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। সেই সঙ্গে সুপারিশকৃতদের বিষয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে তাও প্রকাশ করার ব্যবস্থা রাখলে সেটার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। না হলে বিগত দুটি সার্চ কমিটির মতোই তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও তা সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, যেভাবে আইন হওয়া দরকার সে রকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। শামসুল হুদা কমিশনের সময় আইনের একটি প্রস্তাবিত খসড়া সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছিল। যতটুকু শুনলাম তাতে ওই প্রস্তাবের বিষয়গুলো সেভাবে রাখা হয়নি। তারপরও আইনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) জাবেদ আলী যুগান্তরকে বলেন, দুই বছরের কারাদণ্ডের বিষয়টি সংসদ সদস্যদের বিষয়েও আছে। হয়তো তারই ধারাবাহিকতায় এখানে মানদণ্ড হিসেবে রাখা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে এমনটা থাকা উচিত কিনা তা নিয়ে এখনি মন্তব্য করার সময় আসেনি। সরকার মাত্র খসড়া প্রণয়ন করেছে, এটি নিয়ে আরও অনেক পর্যালোচনা হবে তখন হয়তো সংশোধনও আসতে পারে।

যা আছে খসড়ায় : মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার পদে যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করবে। রাষ্ট্রপতি উপযুক্তদের নিয়োগ দেবেন। এতে সাচিবিক সহযোগিতার দায়িত্ব পালন করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

যোগ্যতা : প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন আর কারা হতে পারবেন না সে বিষয়ে কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনার হতে গেলে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। তাদের বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধাসরকারি বা বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

অযোগ্যতা : প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অযোগ্যতার বিষয় খসড়া আইনে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে কেউ অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হলে, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুবছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ডিত হলে, রাষ্ট্রীয় কোনো পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না।

সব কমিশনের হেফাজত : প্রস্তাবিত আইনের এই খসড়ায় আগের গঠিত সব নির্বাচন কমিশনও এই আইনে গঠিত হয়েছে বলে ভূতাপেক্ষ আইনি হেফাজত দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, যেহেতু এর আগে আইন ছিল না, রাষ্ট্রপতি যেসব নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন, তা এই আইনের অধীনে করেছেন বলে ধরে সেগুলোকে হেফাজত করা হয়েছে।

অনুসন্ধান কমিটি : খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটিতে বিচারকদের মধ্য থেকে দুজন থাকবেন। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক থাকবেন। এছাড়া কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক সার্চ কমিটির সদস্য থাকবেন। এদের মধ্যে আপিল বিভাগের বিচারপতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

অপসারণ : আইন ভাঙলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণের সুযোগও রাখা হয়েছে আইনের খসড়ায়। এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, যেভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা অপসারণ হন, একই পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত নিয়ম-কানুন আইনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত বিধিতে উল্লেখ থাকবে। যাতে প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বারবার আইন সংশোধন করতে না হয় সেজন্য বিধি করে দেওয়া হবে।

নতুন কমিশন এই আইনে : আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে সংসদে এই খসড়া আইন পাশ হবে কিনা। আগামী নির্বাচন কমিশন কী এই আইনের অধীনে হবে কিনা এমন প্রশ্ন রয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, হয়তো হয়ে যাবে। ছোট আইন, আমরা আশা করছি, এটি চূড়ান্ত করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। তিনি বলেন, আজকে (১৭ জানুয়ারি সোমবার) আইনের অনুমোদন দেওয়া হলো, হয়তো কাল-পরশু দুদিন লাগবে আইন মন্ত্রণালয়ের (ভেটিং করতে)। তারপর যদি উনারা সংসদে পাঠান, সংসদেও কয়েকদিন লাগবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে, উনারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। উল্লেখ, সোমবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে করা ইসি সংক্রান্ত সংলাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও আইনের দাবি জানিয়েছে। এদিকে জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনও শুরু হয়েছে রোববার। সরকার চাইলে এই অধিবেশনেই পাশ হতে পারে ইসি গঠনসংক্রান্ত এই আইন।

প্রসঙ্গত, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে অনেক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চলা এ সংক্রান্ত সংলাপেও একাধিক রাজনৈতিক দল আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আইন প্রণয়নের আশ্বাস দিলেও এবারের নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে আইন করা সম্ভব নয় বলে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই এ সংক্রান্ত আইনের খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের ঘোষণা এলো।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top