বিএনপির সামনে পুলিশ পেছনে আওয়ামী লীগ

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ২৮ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪৫; আপডেট: ২ মে ২০২৪ ২১:০০

ছবি: সংগৃহীত

সরকার পদত্যাগের চূড়ান্ত আন্দোলনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। ইতোমধ্যে দলটি শেষ ধাপের আন্দোলনে প্রবেশ করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে তাদের পিছু ছাড়ছে না প্রধান প্রতিপক্ষ সরকারি দল আওয়ামী লীগ। খবর যুগান্তরের। 

বিএনপি যখনই কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে, তখনই একই দিনে সরকারি দল পালটা কর্মসূচি ডাকছে। অপরদিকে শুরু থেকে বিএনপির অভিযোগ-তাদের গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ নানাভাবে বাধা দিয়ে আসছে।

অবস্থাদৃষ্টে বিএনপিকে পেছন থেকে তাড়া করে ফিরছে আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের আন্দোলনে পুলিশকে ফেস করতে হচ্ছে সামনে থেকে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিদ্যমান আন্দোলন কর্মসূচি এমন ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখন আন্দোলন সফল করাই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এভাবেই যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেন বিশ্লেষকদের কয়েকজন।

তাদের মতে, এটা কোনো সুস্থ রাজনীতি নয়, বলা যায় নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে রাজপথের সংঘাতকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হবে। তবে ক্ষমতাসীনরা এসব অভিযোগ মানতে নারাজ।

তাদের মতে, এটা পালটাপালটি কোনো কর্মসূচি নয়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তারা জনগণের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াওসহ নাশকতার পথ বেছে নেয়, তাহলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগও রাজপথে সক্রিয় থাকবে। তাদের অশান্তি সমাবেশের আশঙ্কায় একই দিন আওয়ামী লীগকে শান্তি সমাবেশ করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না, যা খুবই দুঃখজনক। সাম্প্রতিক সময়ে যা দেখছি তাতে আরও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিএনপি কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে দেখা যায় সামনে পুলিশ এবং একই সময়ে থাকে আওয়ামী লীগও।

তিনি বলেন, এটাকে রাজনীতি বলে না। এটা হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ও মুখাপেক্ষী রাজনীতি। অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার। এটা কখনো গণতান্ত্রিক চর্চার রাজনীতি নয়। এ রাজনীতির পরিণতি অশুভ। সংঘাতকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো, যা সামনের দিনে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।’

তিনি বলেন, আমাদের দেশে দলগুলো যা করছে, সেটা অপরাজনীতি। অনেকটা চর দখলের মতো। গণতান্ত্রিক দেশে যে রাজনীতিতে মানুষ তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না, সেটা কখনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে এ পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক ধারায় সুস্থ রাজনীতির চর্চায় ফিরে আসতে হবে।

সাবেক সচিব ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম মো. শহিদ খান যুগান্তরকে বলেন, এক দল কর্মসূচি দেওয়ার পর যখন আরেক দল একই দিনে পালটা কর্মসূচি দেবে-এর দায় কিন্তু তাদের। এটা তো গণতন্ত্রের জন্য খবুই বিপৎসংকেত। আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব দলই তো দাবি করে তারা গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস করে। গণতন্ত্রণকে আরও শক্তিশালী করতে চায়। তাহলে এগুলো কীসের নমুনা।

তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতিতে কখনো এ ধরনের কালচার ছিল না। কোনো দল বেশি সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে চাইলে সেটা অন্যদিন করলে সমস্যা কী। এছাড়া রাজপথে সহিংসতা করলে সেটা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। রাষ্ট্রের কর্মচারীর। সংবিধান কোনো শাসকদলের নেতাকর্মীদের এ এখতিয়ার দেয়নি। ফলে দুই দলের এমন মুখোমুখি অবস্থান দেখে সাধারণ মানুষ সত্যিই আতঙ্কিত। মানুষ শান্তি চায়।’

এদিকে কয়েক মাসের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের শেষদিকে সরকার পতনের আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে গণমুখী কর্মসূচি নেওয়া হয়। ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম দিয়ে শুরু হয় ১০ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ।

অন্যদিকে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা এবং রাজপথ দখলে রাখতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ থেকেই শুরু হয় পালটাপালটি কর্মসূচি। ওইদিন আওয়ামী লীগও রাজধানীতে শান্তি সমাবেশ করে।

এরপর থেকেই যেখানে বিএনপি, সেখানেই আওয়ামী লীগ হাজির-বর্তমান রাজনীতিতে এটাই যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। এর আগে বিএনপি কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামলে তাদের সামনে শুধু পুলিশ দেখা যেত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই একমাত্র বাধা মনে করত বিএনপি। কিন্তু এখন পুলিশের পাশাপাশি থাকছে ক্ষমতাসীনরাও।

বিভাগীয় গণসমাবেশের পর ২৮, ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিএনপি পদযাত্রা ঘোষণা করলে ওই দিনগুলোয়ও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ। ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ঢাকাসহ দেশের ১০টি বিভাগীয় শহরে সমাবেশ ডাকলে আওয়ামী লীগও পালটা শান্তি সমাবেশ করে।

শুধু তাই নয়, কর্মসূচি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বিএনপির সঙ্গে মিল রয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানিতে সমবেদনা জানিয়ে ঢাকার পদযাত্রা স্থগিত করে বিএনপি। ওইদিন আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপি কর্মসূচি স্থগিত করায় একই কারণ দেখিয়ে শান্তি সমাবেশ স্থগিত করে আওয়ামী লীগ।

১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এই কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগও একই দিনে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি সমাবেশ করে। এরপর থেকে এ ধারা চলে আসছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল মিলে বিভাগীয় শহরে তারুণ্যের সমাবেশ করে। তাদের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে ক্ষমতাসীন দলের তিন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ মিলে তারুণ্যের জয়যাত্রা কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

২৪ জুলাই ঢাকায় তাদের এ কর্মসূচি পালন করার কথা ছিল। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর তারুণ্যের সমাবেশ থেকে ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের কর্মসূচি পিছিয়ে ২৭ জুলাই নির্ধারণ করে।

সবশেষ দুই দলকে বৃহস্পতিবার সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। এরপর বিএনপি একদিন পিছিয়ে শুক্রবার মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগও একই দিন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আজ দুই দলের প্রায় পাশাপাশি শোডাউন-সমাবেশ।

বিশ্লেষকরা জানান, বিরোধী দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পালটাপালটি কর্মসূচি শুরুর দিকে ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠ তত উত্তপ্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কম দূরত্বের মধ্যে দুই দলের কর্মসূচি থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সামাল দেওয়াও সহজ হবে না। সব মিলিয়ে এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সামনের দিকে আরও বড় সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শোকের মাসের কর্মসূচি যখন আমরা নিতে যাই, তখন বিএনপি এবং তার দোসররা তো বলেই, কিছু মিডিয়াও এসব পালটাপালটি কর্মসূচি বলে প্রচার করে।

শোকের মাসেও কি আমরা পালটাপালটি কর্মসূচি করতে যাচ্ছি? আমরা তো বলেছি সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকব। ২৪ জুলাই থেকে ২৭, ২৭ থেকে ৩০-এটা আমাদের সুবিধার ব্যাপার। আপনারা (বিএনপি) ডেকেছেন মহাসমাবেশ আর আমাদেরটা হলো তারুণ্যের সমাবেশ। তারুণ্যের যাত্রা।

তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, এখানে পালটাপালটি হলো কী করে? কী কারণে আমরা সংঘাত করব? সংঘাত তারাই করে, যারা দুর্বল, তাদের কোনো সমর্থক নেই। আমরা সংঘাত করতে যাব কেন? আমরা চাই সংঘাতমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু একটা নির্বাচন। এটা আমাদের জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি। বিএনপির সাত জেলা সমাবেশ আর আমাদের সাত উপজেলা সমাবেশ, সাত উপজেলা আর সাত জেলা, পার্থক্যটা দেখবেন।

সবাই দেখেছে। এটা হলো শেখ হাসিনার উন্নয়নের প্রতি আস্থার একটা নিদর্শন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আমাদের প্রতিটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ পালটা কর্মসূচি দিচ্ছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সরকার সহিংসতাকে ছড়িয়ে দিতে চায়। ২৭ জুলাই আমরা মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ তাদের ২৪ তারিখের অনুষ্ঠান পিছিয়ে ২৭ তারিখে নিয়ে যায়। সবশেষ মহাসমাবেশ একদিন পেছানোর পর তারাও পিছিয়েছে। এর উদ্দেশ্য একটাই-তারা জনগণের সঙ্গে সংঘাত করতে চায়।

তিনি বলেন, এই পালটা কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে একটা অনিশ্চয়তার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চায়। পালটা কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, পালটাপালটি সমাবেশ তখনই বলা যায়, তা যদি একই জায়গায় হয়। কিন্তু আমরা তা করিনি। আর এমন নয় যে, এক মসজিদে আজান হলে আরেক মসজিদে আজান দেওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, বিএনপি আমাদের বিরুদ্ধে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি বা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাওয়ার যে অভিযোগ করছে, সেটা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। বরং নির্বাচনে না গিয়ে অতীতে দেশে সহিংসতা সৃষ্টির নজির তাদের রয়েছে।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top