বিএনপির লক্ষ্য নেতাকর্মীদের মুক্তি ও আন্দোলন জোরদার

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারী ২০২৪ ১০:৫৫; আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ২০:০২

ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রসর হতে চায় বিএনপি। সারা দেশের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে রাজপথের অবস্থান জোরালো করতে দলটিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সাংগঠনিক শক্তি ও শৃঙ্খলা ধরে রাখা।

৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর গত বৃহস্পতিবার খুলেছে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সেখানে প্রতিদিনই বাড়ছে নেতাকর্মীদের পদচারণা। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রকাশ্যে আসছেন এবং কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আবারও আন্দোলন চাঙ্গা হওয়ার আশা করছে বিএনপি। এ অবস্থায় নতুন কর্মসূচির পাশাপাশি কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন হলেও যুগপৎভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিএনপি ও মিত্ররা। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুনভাবে শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’ এবং নানা অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ তুললেও বাস্তবতার নিরিখে এখনই সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না দলটি। আপাতত সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ ও গণমিছিলের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

৩৮ জেলায় নেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বেশি ঢাকার
জানা গেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেই পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে দলটির হাইকমান্ড। এ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ করছেন। এরই মধ্যে নির্বাচনের অনিয়ম-ত্রুটি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। সেইসঙ্গে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দূতাবাস, দাতা ও মানবাধিকার সংস্থাকেও এ বিষয়ে অবহিত করবে দলটি। অবশ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে ‘ডামি’ ও ‘প্রহসনের নির্বাচন’ করেছে, তাতে নিজেরাই খুব স্বস্তিতে নেই।

ক্ষমতাসীনরা অজানা আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ, নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কী ধরনের নির্বাচন করেছে, তা দেশবাসী এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব ওয়াকিবহাল। দেশের মানুষ এই নির্বাচনকে ঘৃণাভরে বর্জন ও প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বের খ্যাতিমান গণমাধ্যমগুলো বলেছে, এই নির্বাচনে একটিমাত্র সরকারি দল, নিজেরা ও তাদের ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনটি করছে। এটি একটি ভুয়া ও প্রহসনের নির্বাচন। বিএনপি রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাবে।’

বিএনপির কেন্দ্রসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, আন্দোলন-কর্মসূচি সফল করতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতিতে তারা আশাহত নন। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আলাপকালে জানান, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি রেখে ‘একতরফা নির্বাচন’ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার, যা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র ও পরাজিত প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলছেন। তাছাড়া এই নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। সুতরাং কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি ও আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমেই দাবি আদায়ের প্রত্যাশা বিএনপি-মিত্রদের।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরেকবার আওয়ামী লীগের আসল চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে। জনগণ ভুয়া নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। ডামি ভোটের এই সরকার টিকতে পারবে না।’

দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, ‘একতরফা নির্বাচন করতে বিএনপির বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন করেছে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাহিনী। এখনো গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে এসবে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ নন, তারা মাঠের আন্দোলনেই সফলতা দেখছেন।’

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বলছে, ৫-১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। কিন্তু সরকার সেটাকে বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ৪০ শতাংশের বেশি দেখাচ্ছে। জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট বর্জন ও প্রত্যাখ্যান’ করেছে দাবি করে সারা দেশে ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে লিফলেট ও ফুল দিয়েছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এই দাবিতে ৯ ও ১০ জানুয়ারি দুদিন লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

জানা গেছে, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। ওই বৈঠকে দলটির নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়নে বলা হয়, তাদের ভোট বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে। সুতরাং নির্বাচন বর্জনের আন্দোলন সফল হয়েছে। সারাদিন ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ভোটারশূন্য। এর পরও ৪১.৮ শতাংশ ভোট দেশ-বিদেশে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। আবার নির্বাচনের শেষ এক ঘণ্টায় ১৪ শতাংশ ভোট গ্রহণ হয়েছে। এক ঘণ্টায় এত ভোট পড়ায় কী ধরনের কারচুপি হয়েছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

তাদের ধারণা, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তা ছাড়া হরতাল-অবরোধে নেতাকর্মীরা বেশ ক্লান্ত। এসব দিক বিবেচনায় এই মুহূর্তে শক্ত কর্মসূচি না দেওয়ার পক্ষে অধিকাংশ নেতা। তারা মনে করেন, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিলে সেটিকে ঘিরে অন্য কোনো পক্ষ নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর এর দায় চাপাতে পারে। ফলে সভা-সমাবেশ, কালো পতাকা মিছিলের মতো নতুন কর্মসূচি আসতে পারে। এ বিষয়ে বিভিন্ন দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির যেসব শীর্ষ নেতা কারাবন্দি

জানা যায়, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবআধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একদফা আন্দোলন জোরদার করলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ তোলে বিএনপি। একপর্যায়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রেপ্তার শুরু হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে এখন পর্যন্ত বিএনপির প্রায় ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে দলটির অভিযোগ। কয়েকজন কারাগারেও মারাও গেছেন।

কয়েকজন নেতা কারামুক্ত হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এখনো কারাবন্দি রয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, জহির উদ্দিন স্বপন, বিলকিস জাহান শিরিন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, মো. আমিনুল হক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি আলী আকবর চুন্নুসহ অনেকেই।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ১৩ হাজার ৪৮৯ জনের বেশি অধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মোট ৫০৪টি মামলায় আসামি ৫২ হাজার ৬৯৩ জনের বেশি। হামলায় আহত ২ হাজার ৭৭ জন। আর নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের আগে থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার ৫০৪ জনের বেশি গ্রেপ্তার, ৭৭৫টির বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২৮ ও ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে ১ হাজার ১৭৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৮৫ জনকে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী এখনো ঘরবাড়ি ছাড়া। ভয়াবহ নিপীড়নের মধ্যে মানবেতর দিন যাপন করছেন তারা। এলাকায় গেলে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপদ্রব এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা পরিবারে আক্রমণ করছে। নেতাকর্মীরা অনেকদিন কারাগারে আছেন। এখন তাদের জামিনের বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলব কর্মসূচি বন্ধ হয়নি। আমরা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আছি। নেতাকর্মীরা এখনো জনগণের মাঝে লিফলেট বিতরণ ও কাজ করছেন। শিগগির নতুন কর্মসূচি আসবে।’

রিজভী আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন পার্টি অফিস বন্ধ রেখেছিল। আমরা পুলিশের দেওয়া তালা ভেঙে অফিস খুলেছি। বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিসহ একদফার আন্দোলন কার্যকর রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, এতকিছুর পরও সরকার বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে প্রত্যেক নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। শত নির্যাতন-নিপীড়নেও নেতাকর্মীরা কাজ করবে।

তথ্যসূত্র: দৈনিক কালবেলা 




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top