নির্বাচনী হালচাল : রাজশাহী-১
অর্ন্তকলহে বিপর্যস্থ বিএনপি ॥ শক্ত অবস্থানে জামায়াত
মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:২৬; আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:১৪
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর সংসদীয় ৬ টি আসনের ভোটের মাঠ সরগরম। প্রতিটি আসনেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবং জামায়াত। তবে রাজশাহী-১ আসনে দলীয় অন্তর্কলহে বিপর্যন্ত অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবীতে বিক্ষোভ-সমাবেশসহ বিএনপির মধ্যে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এমন কি বিদ্রোহী প্রার্থীর আশংকা রয়েছে । আর এসুযোগে আসনটিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে জামায়াত।
রাজশাহী-১ আসনটি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা নিয়ে গঠিত। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২টি নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা পাঁচ বার করে ১০ বার এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী একবার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার বিজয়ী হন। আর ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। এখানে ২০১৮ সালে মোট ভোটার সংখ্যা ছিলো ৩লাখ ৮৩ হাজার ৩৫২, ২০২৩-২৪ সালে ৪ লাখ ৪০ হাজার ২১৮ জন এবং এবার বৃদ্ধি পেয়ে ভোটার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬২ জন। যা বছরের তুলনায় ২৮ হাজার ১শ ৪৪ ভোটার বৃদ্ধি হয়েছে। এক হিসেবে দেখা যায় নতুন ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজারের অধীক। এই নতুন এবং তরুণ ভোটারা আগামী নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব রাখবে বলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রাপ্ত তথ্য উপাত্বে উঠে এসেছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপি গত ৩ নভেম্বর কেন্দ্র থেকে রাজশাহী বিভাগের ৩৯ আসনের মধ্যে ৩৪টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। ঘোষণা অনুযায়ী, রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির নতুন প্রার্থী চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিন। তিনি সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাই। ব্যারিস্টার আমিনুল হক ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১ সালে এমপি নির্বাচিত হন। এখানে আরোও কয়েকজন নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। এদের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন, গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সদস্য এ্যাডভোকেট সুলতানুল ইসলাম তারেক, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি সাজেদুর রহমান মার্কনি, জিয়া পরিষদের নেতা অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব এবং প্রকৌশলী কেএম জুয়েল। তবে শরীফ উদ্দিন এবং তারেকের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সবচেয়ে প্রকট। তাদের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ ও পাল্টা-পাল্টি মামলা হয়। এছাড়া মনোনয়ন ঘোষণার পর-পরই কয়েকটি ইউনিয়নে নেতা-কর্মীরা শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে। তাদের অভিযোগ তিনি এলাকায় পরিচিত নন দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে ছিলেন না। স্থানীয় যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে ঢাকায় বসে প্রার্থী চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন ইউনিয়ন বিএনপির নেতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, দলের কঠিন সময়ে যারা মামলা-হামলার মোকাবিলা করেছে, তাদের বাদ দিয়ে হঠাৎ করে ঢাকার লোক এনে দাঁড় করানো মানে তৃণমূলকে অপমান করা।” এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে নির্বাচনী প্রচারণা এক রকম স্থগিত।
একারণে গত কয়েকদিন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও নির্বাচনের আগে বড় ধরণের দলীয় সংঘর্ষের ঘটতে পারে বলে আশংকা রয়েছে। এর আগে গত ২৭ মার্চ দলীয় ইফতার কর্মসূচি শেষে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী গণিউল হক এবং কৃষক দল নেতা নেকশার আলী ২ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এনিয়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে তীব্র বিভাজনের সৃষ্টি হয়। এমন কি এ আসনে বিদ্রোহী প্রার্থীর আশংকা রয়েছে।
অপর দিকে ১৯৮৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এ আসনে বিজয়ী হন। তাকে আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মাত্র ২৫ হাজার ৯১৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আর বিজয়ী প্রার্থী আমিনুল হক পান ৬১ হাজার ৯৭৫। বর্তমানে দলটি প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশসহ জনসংযোগ অব্যহত রেখেছে। দলীয় সমর্থকসহ নেতা-কর্মীরা একাট্টা হয়ে অধ্যাপক মুজিবুর রহমানকে বিজয়ী করতে গোদাগাড়ী-তানোর উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলে নির্বাচনী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গণসংযোগকালে তারা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ভোট ও সমর্থন চাইছেন।
বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তরুণদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যক্টর। এ আসনে ২০১৪-১৮ ও ২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। অর্থাৎ ২০০৮ সালের পর এই আসনে টানা তিন বার আওয়ামীলীগের প্রার্থী জয়লাভ করলে এলাকার উল্লেখ্য যোগ্য কোনই উন্নয়ন হয়নি। বরং ক্ষমতার দম্ভে সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী নিজ দল আওয়অমীলীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেন। আর মসনদে থেকে ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়েছেন। এনিয়ে আওয়ামীলীগের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ভোটের রাজনীতে নীরব রয়েছেন। এসব সচেতন ভোটারদের বড় একটি অংশ এলাকার উন্নয়নের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন দিতে পারে।
এছাড়া তরুণ ভোটাররা ক্লিন ইমেজ এবং দুর্ণীতিমুক্ত প্রার্থীদের অগ্রধীকার দিচ্ছেন। যদিও বিএনপির নতুন প্রার্থী শরিফ উদ্দিন ক্লিন ইমেজ এবং দুর্ণীতিমুক্ত একজন ব্যক্তি। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিশাল বরেন্দ্র এলাকার ডিপ টিউবয়েল, অপারেটর বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতে জড়িয়ে রয়েছে। তরুণ ভোটারগণের অভিমত, বিগত সময়ে শরিফ উদ্দিনের ভাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হক যথেষ্ট জনপ্রিয় একজন নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনিও স্থানীয় বিএনপির কাছে ছিলেন অসহায়। তাকে পুঁজি করে উপজেলা বিএনপি নেতা প্রয়াত শীষ মোহাম্মদ দুর্ণীতির পাহাড় গড়ে তোলেন। ব্যারিস্টার আমিনুল হক নাম করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে নিয়োগ বানিজ্যসহ সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেন। এসময় কথা ছড়িয়ে পড়ে তানোরের এমন একটি বাড়ি নেই যে, বাড়ি থেকে কোন টাকা নেয়নি শীষ মোহাম্মদ। এসব ঘটনায় ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিতর্কিত হলেও কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলেও অভিযোগ আছে।
এবারের নির্বাচনে তরুণ এবং সচেতন ভোটাররা এসব বিষয়কেযথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করছেন। সব মিলিয়ে এ আসনে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে বলে স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। সব মিলে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে বহুল পরিচিত এই আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে বিএনপি। তবে তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মনোনয়ন বঞ্চিতরা প্রার্থী। আর বাড়তি সুযোগ পেয়ে জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
রাজশাহী-১ আসনের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির দলীয় কোন্দল তীব্র। আর প্রার্থী পরিবর্তনের দাবির আন্দোলনে বিএনপি চরম বিপর্যস্থ অবস্থায় রয়েছে। আর গত ফেব্রুয়ারিতে প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও প্রস্তুতিতে সার্বিকভাবে এগিয়ে আছে জামায়াত। তবে চুড়ান্ত জনপ্রিয়তা আর ফলাফল উঠে আসবে জনগনের ভোটাধিকারের মধ্য দিয়ে। একই সাথে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার রক্ষায় নির্বাচিত এমপিগণ যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন বলে স্থানীয়রা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: