নির্বাচনী হালচাল: প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে দুই দলে
রাজশাহী-৪: বিএনপিতে ভাঙ্গন, এগিয়ে জামায়াত
শাহ্ সুফি মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২৯; আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:১৮
রাজশাহীর আলোচিত সংসদীয় আসন রাজশাহী-৪। এক সময় ‘রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত বাগমারা আসনটি ২০০৮ সালে গঠিত হয়। এর আগে মোহনপুর-বাগমারা উপজেলা নিয়ে ছিল রাজশাহী-৩ সংসদীয় আসন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এই আসনেও মনোনয়ন লড়াইয়ে বিএনপির তৃণমূল বিভক্ত। বিএনপি মধ্যে বিভক্ত আর ভাঙনের লাভবার হচ্ছে জামায়াত। একক প্রার্থী নিয়ে শক্ত অবস্থানে মাঠে রয়েছে দলটি। নাগরিক কমিটি (এনসিপি), খেলাফত মজলিস, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থীদের নাম সামনে আসলেও তাদের কোন প্রার্থী বা দলের প্রচার-প্রচারণা নেই। নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে।
উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌর এলাকা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৪। ভোটার সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬ শ ৬৪। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। দলটির একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে বিভক্তি স্পষ্ট। পাশাপাশি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সমর্থকদের মধ্যে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। যা দলীয় ঐক্যের ঘাটতির পাশাপাশি নির্বাচনী কৌশলে বিএনপিকে যথেষ্ট চাপে ফেলেছে। অথচ রাজনৈতিক ইতিহাস, দলীয় সুসংগঠিত অবস্থা ও ভোটের সমীকরণসব মিলিয়ে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই আসনটি বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে বিএনপির নতুন মুখ বাগমারা উপজেলা আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান।
অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ছিলেন, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন, রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক সহ-সম্পাদক ড্যাব নেতা ডা. আশফাকুর রহমান শেলী। জিয়াউর রহমান বিগত সময়ে নির্যাতিত হলেও তার বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নানা অভিযোগ তুলে মনোনয়ন বাতিলের দাবি করছেন। গত ১৬ নভেম্বর উপজেলার ভবানীগঞ্জে তাঁর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে গণ-সমাবেশ হয়। সম্প্রতি থানায় পুলিশকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জিডিও হয়েছে। এছাড়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামাল হোসেনের সমর্থকদের বাড়িঘরে ককটেল হামলা, পুকুরের মাছ বিষ দিয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে। এমন কি তার ভাই ও আউচপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাফিকুল ইসলাম শাফির বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয় বিএনপির ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই বাগমারা বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি অংশ দখলবাজিতে নামে। উপজেলা জুড়ে চলছে পুকুর দখলের মহোৎসব। থেমে নেই জমি দখলও। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কৃষি জমি নষ্ট করে অবাধে চলছে পুকুর খনন। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদও দখলের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আরও অভিযোগ, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দু-একজন পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে মিশে গেছে। তাদের অনেকেই এখন নিজেদের বিএনপি কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সেল্টার দিচ্ছেন ডিএম জিয়াউর রহমান। এসব অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিরা একাট্টা হয়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ১৯৯০ দশকের মতো বাগমারা যেমন চরমপন্থী, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারার ঘাঁটি ছিল তেমনি আবার ফিরে আসে কিনা?
অপর দিকে অন্যদিকে একক প্রার্থী নিয়ে মাঠে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামী। দলটি দীর্ঘদিন ধরেই বাগমারা এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করে আসছে। এ আসনে বিএনপি’র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছে উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর ভবানীগঞ্জ ক্লিনিকের পরিচালক ডাঃ আব্দুল বারী। তিনি ইতোমধ্যে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই আসনটি জামায়াতের দখলে রইবে এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট দলের নেতৃবৃন্দর। ডাঃ বারি পরিচ্ছন্ন ও উন্নত বাগমারা গড়ার জন্য জমায়াতে ইসলামীর প্রতীক দাঁড়িপাল্লায় ভোট চাইছেন। পথসভায় সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং সকল বৈষম্য ও হানাহানির অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকার প্রত্যায়ে মাঠে চষে ফিরছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রভিত্তিক কর্মী ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত সাংগঠনিক সভা এবং ভোটার যোগাযোগের মাধ্যমে জামায়াত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভক্তিকে সুযোগ হিসেবে দেখছে দলটি।
এদিকে নাগরিক কমিটি (এনসিপি), খেলাফত মজলিস, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থীদের নাম আলোচনায় এসেছে। তবে মাঠপর্যায়ে তাদের কোনো প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়ছে না। পোস্টার, সভা কিংবা ভোটার সংযোগ কার্যক্রমে দলগুলোর দৃশ্যমান না হওয়ায় ভোটের লড়াইয়ে কার্যত প্রভাব রাখার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা। ফলে ভোটের বাস্তব হিসাব অনুযায়ী রাজশাহী-৪ আসনে মূল লড়াই গড়াবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি দ্রুত অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কাটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে, তাহলে আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় ভোটারদের ভাষ্য, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই এবারের ভোটের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সেই সঙ্গে প্রার্থী নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত ও মাঠপর্যায়ের ঐক্যই নির্ধারণ করবে রাজশাহী-৪ আসনের চূড়ান্ত ফলাফল।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: