বদর যুদ্ধ

আবু জাহেলকে যেভাবে হত্যা করেছিল দুই কিশোর

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২৪ ১৫:০৩; আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২১

ছবি: ফাইল

ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে বদর যুদ্ধ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কাফেরদের চরম শত্রুতার কারণে আল্লাহর নির্দেশে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

বদর যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নগণ্যসংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তাআলার গায়েবি সাহায্যে আবু জাহেলের বিশাল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন। এই যুদ্ধকে কোরআন কারিমে ‘সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ যুদ্ধের বিজয়ই মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়।

এ যুদ্ধে মারা যায় কাফের শক্তির প্রধান সেনাপতি আবু জাহেল। দু’জন কিশোর সহোদর ভাইয়ের হাতে নিহত হয় প্রতাপশালী এই কাফের নেতা।

দুই সহোদর যখন শুনেছেন কাফেরদের সর্দার আবু জাহেল নবীকে মক্কায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। নির্মম নির্যাতনের পর নবীজি মদিনায় আসার পথেও তাকে শান্তি দেয়নি এবং হত্যার চেষ্টা করেছিল। নবীকে কষ্ট দেয়ার এসব কথা শুনে তারা শপথ করেছিলেন, আবু জাহেলকে দেখামাত্রই হত্যা করবেন।

আবু জাহেল বদর প্রান্তরে এসেছে। তার ইচ্ছা, আল্লাহর নবী ও মুসলমানদের এবার শেষ করে দেবে। এদিকে আবু জাহেলের রক্তে হাত রাঙানোর শপথে বলীয়ান দুই সহোদর ভাইও বদর মাঠে উপস্থিত। চোখে-মুখে আবু জাহেলকে হত্যার নেশা। মনে বহুদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ। নাঙা তলোয়ার হাতে দাঁড়ালেন বদরপ্রান্তরে।

যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশ পক্ষের বীর উতবা, ওয়ালিদ হুঙ্কার ছেড়ে প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্বের আহ্বান জানায়। তখন মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে প্রথম আফরার তিন ছেলে মুয়াজ, মুয়াওয়িজ ও আওফ (রা.) তরবারি হাতে ময়দানের দিকে অগ্রসর হন। রাসুল (স.) তাদের বাধা দেন। হামজা (রা.), আলী (রা.) ও অন্যদের এগিয়ে দেন। প্রাণের নবীর দুশমনকে হত্যার নেশা দুই ভাই মুয়াজ ও মুয়াওয়িজ উদ্দীপ্ত করে চলছে। তারা ছুটে চললেন। গিয়ে দাঁড়ালেন এক ব্যক্তির মাঝখানে। টার্গেট আবু জাহেল। কিন্তু আবু জাহেলকে তারা চিনেন না। দুই তরুণের মাঝখানের সেই ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)।

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বর্ণনা করেন— ‘আমি বদর যুদ্ধের সারিতে দাঁড়িয়ে আছি। যুদ্ধ বেঁধে গেছে। আমি আমার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখি অল্প বয়স্ক দু’জন আনসার যুবকের মাঝে আমি রয়েছি। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাদের চেয়ে শক্তিশালীদের মধ্যে থাকি। তখন তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, চাচা! আপনি কি আবু জাহেলকে চিনেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ। তবে ভাতিজা, তাকে তোমার কী প্রয়োজন? সে বলল, আমি জানতে পেরেছি, সে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে গালমন্দ করেছে। আমি আল্লাহর সঙ্গে চুক্তি করে এসেছি— যার হাতে আমার প্রাণ। আমি তার ওপর আক্রমণ করব এবং আক্রমণ চালিয়েই যাব যতক্ষণ আমাদের মধ্যে কেউ একজন না মরবে। যার মরণ আগে নির্ধারিত সেই মরবে। আমি হই বা সে...।

আমার হৃদয় সাহসে ভরে গেল। আমি তার কথায় বিস্মিত হলাম। তা শুনে দ্বিতীয়জন আমাকে অনুরূপ বলল। তৎক্ষণাৎ আমি আবু জাহেলকে দেখলাম। সে মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন আমি বললাম, এই যে তোমাদের সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে। তারা তৎক্ষণাৎ নিজের তরবারি নিয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে হত্যা করল। এরা হলো, আফরার দুই পুত্র।’ (বুখারি: ৩৯৮৮)

মুয়াজের বর্ণনায় আবু জাহেল হত্যার চিত্রপট এভাবে বর্ণিত হয়েছে— ‘আমি যখন আবু জাহেলকে চিনে নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্দেশ্য করে রওনা করলাম। মুশরিকরা তার নিরাপত্তার জন্য চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। একজন মুসলিম সৈনিক আমাকে লক্ষ করে বললেন, ওহে বালক, আবু জাহেলের কাছে যেও না। তোমার ওপর কঠিন বিপদ নেমে আসবে। আল্লাহর কসম, তার সাবধান বাণী শুনে আমার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। তাকে হত্যার দৃঢ়তা বৃদ্ধি পেল।

আমি আবু জাহেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। সুযোগ পেয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ক্ষিপ্র বেগে আঘাত করলাম। প্রচণ্ড গতির আঘাতে তার পায়ের গোছা শরীর থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে থুবড়ে পড়ল। আমার ভাই মুয়াউওয়াজও আমার অনুসরণ করল।

সে আবু জাহেলের ওপর চড়ে বসে তার গলায় ছুরি চালাতে থাকল। মুশরিকরা আবু জাহেলকে বাঁচানোর জন্য তার দিকে তীর, বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। চতুর্মুখী আক্রমণে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। তিনি শহিদ হয়ে আবু জাহেলের পাশেই পড়ে রইলেন। আবু জাহেলের পুত্র ইকরামা আমার কাঁধের ওপর তরবারির আঘাত চালাল, আমার বাম হাত কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার উপক্রম হলো। কিন্তু হাতটি বাম পাঁজরের চামড়ার সঙ্গে ঝুলে থাকল।’

যুদ্ধ থেমে গেল। মুশরিকরা পালানোর পথ ধরল। ৭০ মুশরিক বন্দি হলো। ৭০ জন মারা পড়ল। মুসলমানদেরও ১৪ জন শহিদ হয়ে জান্নাতে পৌঁছে গেল। রাসুল (স.)-এর কাছে আবু জাহেলের মৃত্যু সংবাদ আসে। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। প্রীত হলেন। দুই বালকের শপথে বলীয়ান ও সাহসের গল্প শুনলেন। আল্লাহর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের আকুণ্ঠ সমর্পণ দেখে তিনি বেজায় খুশি হলেন। তাদের জন্য দোয়া করলেন। কাছে ডাকলেন।

বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুমে ঘটনাটি এভাবে এসেছে- আবু জেহেলকে চেনামাত্রই উভয় আনসার কিশোর আবু জাহেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে তাকে হত্যা করে ফেলল। এরপর উভয়ে প্রিয়নবী (সা.)-এর কাছে এলো। নবী (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আবু জাহেলকে হত্যা করেছো? উভয়ে বললো, আমি করেছি, আমি করেছি।

নবী (স.) বললেন, তোমরা কি তলোয়ারের রক্ত মুছেছো? তারা বললো, না মুছিনি। নবী (স.) উভয়ের তলোয়ার দেখে বললেন, তোমরা দুজনেই হত্যা করেছো। এই দুই কিশোরের নাম ছিল- মাআজ ইবনে আমর জামুহ এবং মুআওওয়াজ ইবনে জামুহ ইবনে আফরা (রা.)। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ২২৬)

আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাদের কাজে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘ওই দুই ভাইয়ের মধ্যে অবস্থান করে আমি যে আনন্দ পেয়েছি, তা আর কোনো দু’জনের মধ্যে অবস্থান করে পাইনি, রাসুলের কথা আলাদা।’

ইতিহাসের নিকৃষ্ট চরিত্র আবু জাহেলের হত্যাকারী দুই মুসলিম তরুণের মা আফরা বিনতে উবাইদ (রা.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে বিরলতম উদাহরণ। এ মহীয়াসী নারীর সাত সন্তানই বদরযুদ্ধে অশংগ্রহণ করেছিলেন।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top