রাসূলুল্লাহর (স.) প্রতি আবু তালেবের ভালোবাসা ও আমরা

তারিকুল ইসলাম: | প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৫২; আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:০১

ছবি: সংগৃহীত

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স) হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। যিনি তাঁর জন্মের পূর্ব থেকেই প্রশংসিত ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব। যার গুণগানে অতীত থেকে রচিত হয়ে আসছে অসংখ্য বই, প্রবন্ধ, সিনেমা, নাটক, অডিও-ভিডি ডকুমেন্টারি ও তথ্যচিত্র।

গবেষণা ও লেখালেখি করে চলেছেন অগণিত গবেষক, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীসহ অসংখ্য শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে এগুলো কিন্তু শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

তাঁর প্রতি যুগে যুগে ভালোবাসা পোষণ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অসংখ্য অমুসলিম মনীষী। যারা নবীজীকে রাসূল হিসেবে অনুসরণ ও আনুগত্য করেননি কিন্তু তাঁর কাজের প্রতি মুগ্ধ, উদ্বেলিত ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বহু কাজ করেছন যেমন- গবেষণা, কবিতা, বই, প্রবন্ধ, সিনেমা ইত্যাদি।

কিন্তু একজন মুসলিম ব্যক্তি নবীজীকে শুধু ভালোবাসবে অথচ তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্য করবে না এটা হতেই পারে না। তিনি যা আদেশ করেছেন তা মানা এবং যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করা, সকল কাজে তাঁকে মানদন্ড হিসেবে ধরাই হচ্ছে একজন নবী প্রেমিকের কাজ। শুধুমাত্র নবীজীকে ভালোবেসেই জান্নাতী হওয়া গেলে তো আবু তালেব জান্নাত পেয়ে যেতেন।

কেননা আবু তালেব যে পরিমাণ ভালোবাসা ও সহযোগিতা নবীজীকে করেছেন আমাদের সম্মিলিত ভালোবাসাও তার কাছে গৌণ হয়ে যাবে। অথচ তিনি বংশের দূর্নাম এবং বাপ দাদার ধর্মের পরিবর্তে ভাতিজার ধর্মের অনুসারী হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। ফলে তাকে জাহান্নামের জুতা পরিধান করানো হবে বলে হাদীসে এসেছে।

বর্তমানে অনেক মুসলিমদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যারা রাসূল (সা) কে ভালোবাসার দাবি করে অনেক কর্মসূচি পালন করছে। রাসূলের শানে কাওয়ালী গান, গজল, জশনে জুলুস, নাতে রাসূল (সা). র্যালি, ওরশের নামে গান বাজনা ইত্যাদি। আশেকে রাসূল হওয়ার জন্য আর কত আয়োজন! তারা নিজেদের প্রকৃত আশেকে রাসূল মনে করছে। কিন্তু তাঁর আদেশ নিষেধের কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না অনেকক্ষেত্রেই। রাসূলের বন্দনায় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বাদ যাচ্ছে নামাজের মত ফরজ ইবাদাত, হচ্ছে নারী পুরুষের সংমিশ্রণ। বাজছে বাদ্যযন্ত্র ও ঢোল তবলা।

আসুন সিরাত থেকে দেখি নবীজীর প্রতি আবু তালেবের ভালোবাসার নমুনা:

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মা আমেনার ইন্তিকালের পর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের অভিভাবকত্বে বড় হন। নবী (সা.) এর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর দাদাও মারা যান।

মৃত্যুর আগে আব্দুল মুত্তালিব নিজের পুত্র আবু তালেবকে ওসিয়ত করে যান- যেন নবী (সা.) এর বিশেষ যত্ন নেন। এরপর আবু তালেব নবীজীকে গভীর স্নেহ-মমতার সাথে লালনপালন করেন। এমনকি নিজ সন্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বরং নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন। চল্লিশ বছরের বেশি সময় পর্যন্ত নবীজীকে সহায়তা দেন। নবীজীর প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি মানুষের সঙ্গে শত্রুতা মিত্রতার বন্ধন স্থাপন করতেন। (আর রাহিকুল মাখতুম

এদিকে নবীজীর নবুয়ত প্রাপ্তির পরপরই মক্কায় তাওহীদ ও রিসালাতের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। প্রথমে গোপনে এরপর প্রকাশ্যে। সর্বোপরি মানুষকে দেব-দেবী বা মূর্তিপূজার পরিবর্তে এক আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি আহ্বান করতে থাকেন। ক্রমেই নবীজীর দাওয়াতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছিলো। তবে কুরাইশ সর্দাররা শুরু থেকেই এই দাওয়াতের বিরোধিতা করে। এসময় নবীজীর প্রিয় চাচা আবু তালেব বিরোধিতা তো নয়ই উল্টো সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন করেছেন।

আবু তালেবের সহযোগিতার বিষয়টি কুরাইশরা বুঝতে পেরে একদিন তার কাছে গিয়ে বললো, "হে আবু তালিব, আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছে।

এমতাবস্থায় হয় আপনি তাকে এসব থেকে বিরত রাখুন নতুবা তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দিন।" আবু তালিব তাদেরকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদায় করলেন। (সিরাত ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ৬১, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)

আবু তালেব ও নবীজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুশিয়ারী

এদিকে নবীজী যথারীতি তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কুরাইশরা এবার তীব্র সমালোচনা ও উস্কানীমূলক কথাবার্তা শুরু করলো।

এবার আবু তালেবের কাছে কুরাইশরা হুমকি দিয়ে বললো, "আপনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও মুরুব্বি। আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনার ভতিজা অনেক বাড় বেড়েছে। ক্রমাগত আমাদের ধর্ম ও দেবদেবীর সমালোচনা করছে। এবার তাঁকে থামান নয়তো আপনাকে সহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং একপক্ষ ধ্বংস হওয়ার আগে আর থামব না।" ( সিরাত ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা-৬২)

আবু তালেব এবার ঘাবড়ে গিয়ে নবীজীকে একান্তে ডেকে বললেন, 'আমার ও তোমার প্রাণের দিকে খেয়াল করো। আমাকে এত বেশি বোঝা দিয়ো না, যা আমি বহন করতে পারব না। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড পৃষ্টা-২২১)

নবীজী বুঝে যান চাচা এখন আর তাকে সহযোগিতা করতে পারবেন না। কিন্তু নবীজীও তো দাওয়াতের এই মহান দায়িত্ব ছাড়তে পারেন না। আবু তালেবকে বললেন, "চাচাজান, আল্লাহর কসম, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় এবং এই কাজ ছেড়ে দিতে বলে, তবুও আমি বিরত হব না। যতদিন না আল্লাহ এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন অথবা আমি এই চেষ্টায় প্রাণ উৎসর্গ করব। "

এতটুকু বলতেই নবীজীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে যান। আবু তালেব এ দৃশ্য দেখে ব্যাকুল হয়ে নবীজীকে ডেকে এনে বলেন, ' ভাতিজা, তোমার যা মন চায় তাই করো। যেভাবে চাও ইসলামের প্রচার করো। আমি তোমাকে কখনো একা ছেড়ে দেব না।' (সিরাত ইবনে হিশাম,পৃষ্ঠা ৬২)

নবীজীর বিনিময়ে যুবককে প্রদানের প্রস্তাব

কুরাইশরা আবু তালেবের নবীজীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পেরে উমারাহ ইবনে ওয়ালিদ নামক এক যুবককে নিয়ে গেল। তাকে বললো, ' হে আবু তালেব, উমারাহ হচ্ছে কুরাইশ গোত্রে সবচেয়ে সাহসী, শক্তিমান ও সুদর্শন যুবক। একে আপনি পুত্র হিসেবে গ্রহণ করুন।

এর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পারবেন। আর আপনার ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন এবং তাকে হত্যা করবো। একজন মানুষের বিনিময়ে একজন মানুষ আপনি পেয়ে যাচ্ছেন।"

আবু তালেব বললেন, " আল্লাহর কসম, তোমরা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছ। আমি কি এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যে, তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে দেবে, আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করবো আর আমার সন্তান তোমাদের হাতে তুলে দেবো, তোমরা তাকে হত্যা করবে? খোদার কসম, জেনে রেখো, এটা কখনো হবে না।"

এবার ব্যাপারটা সবার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিল। কুরাইশরা পরস্পরকে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। বিভিন্ন গোত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবা ছিলেন এবং যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে কুরাইশরা পরস্পরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো।

প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে দিল এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠোর চাপ দিতে লাগলো। একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতন থেকে নিরাপদ রইলেন। চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করলেন।

আবু তালেবের অবর্তমানে নবীজী:

আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন নির্যাতন শুরু করলো, আবু তালিবের জীবদ্দশায় যা তারা করার সাহস করেনি। এমনকি একদিন কুরাইশদের একজন অত্যন্ত নীচাশয় অর্বাচীন তার চলার পথে গতিরোধ করে তাঁর মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় ধুলো নিয়ে বাড়ী গেলেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাথার ধুলো মুছে পরিষ্কার করে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছিলেন, "মা, কাঁদিস না! তোর আব্বাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন।" এ পর্যায়ে তিনি বললেন, "আবু তালিব মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আমার সাথে কোন রকম খারাপ আচরণ করতে পারেনি।"

আবু তালেবের ইন্তেকালের মুহূর্ত:

মদীনায় হিজরতের তিন বছর আগে এবং মিরাজের বছর নবীজীর প্রিয় চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন নবীজীর সহায় ও ঢালস্বরূপ। কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতেন এবং তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতেন।

কিন্তু মৃত্যুর সময় আবু তালেবকে নবীজী অনেক পীড়াপীড়ি করেও একবারের জন্য কালেমা পড়াতে পারেননি। নবীজীর আগ্রহ দেখে আবু তালেব বললেন, "ভাতিজা, আমার মৃত্যুর পরে তোমার ও তোমার ভাই বেরাদরের অপমানিত হতে হবে এবং কুরাইশরা ভাববে যে আমি শুধু মৃত্যুর ভয়ে ঈমান এনেছি। এই আশংকা যদি না থাকতো তা হলে আমি কালেমা পড়তাম ও ঈমান আনতাম। আমি শুধু তোমাকে খুশী করার জন্যই এ কথা বলছি।"

এরপর আবু তালেবের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে আব্বাস দেখলেন, আবু তালিব ঠোঁট নাড়ছেন। তিনি তাঁর মুখের দিকে কান এগিয়ে দিলেন। তারপর নবীজীকে বললেন, "ভাতিজা, তুমি যে কালেমা পড়তে বলেছো, আমার ভাই তা পড়েছে।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, "আমি শুনতে পাইনি।"

কুরআনের আলোকে আনুগত্যের দাবি:

সূরা আলে ইমরানের ৩১ নং আয়াতে নবীজীকে বলতে বলা হয়েছে- বলুন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (অনুবাদ; আল-বায়ান)

ইবনে কাছীর (রহ.) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে বলে দাবি করে, অথচ সে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরীকা মত চলে না, সে ভালোবাসার মিথ্যুক দাবিদার। তার দাবি সত্য হবে তখনই, যখন সে তার যাবতীয় কথা ও কাজে মুহাম্মাদী শরীআতের অনুসারী হবে (-অনুবাদক, তাফসীরে ইবনে কাছীর থেকে)। একই কথা তাদের জন্যও প্রযোজ্য, যারা নবীপ্রেমের দাবি করে, অথচ তাঁর শরীআত ও সুন্নতের সাথে তাদের জীবনের কোন মিল পরিলক্ষিত হয় না।

লেখক, তারিকুল ইসলাম, শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top