রোহিঙ্গা কবজায় মোবাইল ব্যাংকিং, চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা! 

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারী ২০২৪ ১১:২৯; আপডেট: ৭ মে ২০২৪ ১৯:২৩

ছবি: সংগৃহীত

শফি আলম টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোচনীপাড়া এলাকার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বড় এজেন্ট। বেশি লেনদেনের কারণে তিনি সেরা এজেন্টের পুরস্কারও পেয়েছেন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। গত কয়েক মাসে তার এজেন্ট নম্বরের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে অন্তত অর্ধকোটি টাকা। এজেন্টদের মধ্যে ওই এলাকায় তিনি বেশ প্রভাবশালী।

তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, এই শফি বাংলাদেশের নাগরিকই নন! তিনি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। দেশটি থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে টেকনাফে স্ত্রীসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন তিনি দুই সন্তানের বাবা। তাদের পুরো পরিবারই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। কাগজপত্র অনুযায়ী শফি আলম পরিবার নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকার কথা। কিন্তু তিনি এখন মোচনীপাড়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বড় এজেন্ট!

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের নিবন্ধিত সিম দরকার। মোবাইল ফোনের সিমের সেই নিবন্ধন বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের কোনো নাগরিকের পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু রোহিঙ্গা হয়েও শফি আলম তা পেলেন কীভাবে এবং এত টাকার লেনদেনের নেপথ্যেই বা কী—সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ সব তথ্য।

পাহাড়-জঙ্গলের কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা এই টেকনাফ। এই উপজেলার সীমান্তে জনবসতিও তুলনামূলক কম। বড় ব্যবসা-বাণিজ্যও নেই। তবুও টেকনাফে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রেকর্ড পরিমাণ লেনদেনে আলোচনায় এই এলাকাটি। শফি আলম ছাড়াও বিপুল পরিমাণ লেনদেনের কারণে অসংখ্যবার পুরস্কারও পেয়েছেন সেখানকার অনেক স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট। টেকনাফে আছে প্রায় সব ব্যাংকের শাখাও।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অস্বাভাবিক পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের নেপথ্যে মাদকের কারবারিরা। মাদকের অবৈধ টাকা লেনদেনে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মোবাইল ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক। এর প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণও রোহিঙ্গাদের হাতে।

এবার অনুসন্ধান শুরু, একজন রোহিঙ্গা কীভাবে সিমকার্ডের নিবন্ধন নিলেন এবং হ্নীলা এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করলেন? এজেন্টের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, এজেন্ট হিসেবে শফি আলম যে লাইসেন্স ব্যবহার করছেন, সেটি হ্নীলার মোচনীপাড়া ‘মুফিজ ক্রোকারিজ’-এর নামে নিবন্ধিত। ট্রেড লাইসেন্সও রয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের। এর মালিক মুফিজ আলম। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বিকাশ এজেন্টের নিবন্ধন নিয়েছি। নিজের ক্রোকারিজ দোকানের জন্য এটা করলেও এখন সক্রিয় নয়।’ তিনি শফি আলমকে চেনেন না বলেও দাবি করেন।

অবশ্য যাচাই করে দেখা যায়, মুফিজ আলমের নামেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধন করা মোবাইল নম্বরটি (০১৮৭০৪৩২৯..)। এতে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। যাচাই করে দেখা যায়, সিমটি নিবন্ধন করা খাইরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির ঠিকানায়। সিমের নিবন্ধনের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, খাইরুলের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বালিয়াতলী ইউনিয়নের বালিপাড়া গ্রামে। পটুয়াখালীর বাসিন্দার নামে নিবন্ধিত সিম টেকনাফে রোহিঙ্গার হাতে কীভাবে গেল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সিমের মালিক খাইরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে নিবন্ধিত এজেন্ট রোহিঙ্গা শফি আলমকে চেনেন না বলে মুফিজ আলম দাবি করলেও আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, এই মুফিজ তার এজেন্ট নম্বরটি শফি আলমকে জেনেশুনেই দিয়েছেন এবং তিনি তার ব্যবসায়িক অংশীদার। তার মতো টেকনাফের অনেক স্থানীয় বাসিন্দাই নিজেদের নামে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট বা মোবাইল সিমের নিবন্ধন নিয়ে টাকার বিনিময়ে তা রোহিঙ্গাদের কাছে তুলে দিচ্ছে।ক

কথা হয় শফি আলমের সঙ্গেও। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য ব্যবহৃত নম্বরটিতে ফোন দিয়ে তাকে বলা হয়, ‘তার মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এই নম্বরটি ব্যবহার হয় কি না? তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে জানতে চান, ‘কত টাকা পাঠাবেন?’

তাকে কয়েকটি নম্বর থেকে ৫০ হাজার টাকা পাঠানোর কথা বলা হলে তিনি জানতেন চান, ‘কীসের টাকা?’

আচার কেনার টাকার কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘আমি অবৈধ টাকা লেনদেন করি না, এ জন্য জিজ্ঞেস করলাম।’ পরে অবশ্য সাংবাদিক পরিচয়ে ফোন দিয়ে তারসম্পর্কে জানতে চাইলে অসংলগ্ন কথা বলেন। নেটওয়ার্কে ঝামেলার কথা বলে ফোন কেটে দেন। এরপর কয়েক দফা ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি।

নেপথ্যে ছেনু আরা ও রোহিঙ্গা হাশেম:

শফি আলমের মতোই আরেক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট হ্নীলার বাসিন্দা ছেনু আরা। প্রকাশ্যে এজেন্ট ব্যবসা করলেও স্থানীয় লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, এই ছেনু আরা মূলত একজন মাদক কারবারি। তিনি বাংলাদেশি হলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্যতম হোতা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এজেন্ট ব্যবসার আড়ালে সে মূলত অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকের টাকা লেনদেন করে থাকে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছেনুর এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মোবাইল নম্বরের (০১৮৮৭৬৬৪১..) সিমটি কক্সবাজার সদরের এক ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত।

ছেনুর বাবার নাম আনু মিয়া, হ্নীলার মোচনী নয়াপাড়া এলাকায় তার বাড়ি। দোকানের নাম জুনায়েদ স্টোর। অবশ্য ছেনুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। গত কয়েকদিন ধরে তার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বরটিও বন্ধ। তার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার গ্রুপের সঙ্গে অন্য সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলির ঘটনার পর সে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এলাকায় জনশ্রুতি আছে, সম্প্রতি সে পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়া চলে গেছে।

অবশ্য ছেনু যে মোবাইল সিমটি দিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং করছেন, সেটি যার নামে নিবন্ধিত সেই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই ব্যক্তি নাম প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখাননি। তিনি দাবি করেন, সিমটি তিনি বহুদিন ব্যবহার করেন না। অন্যের হাতে সেটি কীভাবে গেছে তাও জানেন না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ছেনু মিয়া ও রোহিঙ্গা শফির নেপথ্যের হোতা আরেক রোহিঙ্গা আবদুল হাশেম। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে জন্ম নেওয়া এই হাশেম গত বছরের অক্টোবরে শরণার্থী কার্ড পান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই হাশেম শফির ঘনিষ্ঠজন। কাগজপত্রে ক্যাম্পের বাসিন্দা হলেও অবাধে মিয়ানমারে যাতায়াত করেন। দেশটি থেকে ইয়াবা এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করে থাকেন। এসব ইয়াবা পাচারের টাকা এসে জমা হয় শফি ও ছেনু মিয়ার এজেন্ট হিসাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শফি ছাড়াও ওই এলাকায় অন্তত ৭ রোহিঙ্গা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা স্থানীয় লোকজনের নামে শত শত মোবাইল সিম নিবন্ধন করে এই বাণিজ্য করে আসছে। এই রোহিঙ্গাদের উবাইদুল, কাদের, শাকের, জিয়াবুল, সাইমুন, আইউব ও আরমান শফি টেকনাফের হ্নীলা, লেদা ও মোচনীসহ গোটা এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করে আসছে। তাদের দাপটে স্থানীয় সাধারণ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরাও কোণঠাসা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এক সময় টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক কারবারিরা হুন্ডির মাধ্যমে মাদকের টাকা পরিশোধ করত। এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তা করা হচ্ছে। এতে মাদক কারবারিদের চিহ্নিত করতেও বেগ পেতে হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সভায়ও উপস্থাপন করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেন হচ্ছে, বিষয়টি সত্যি। টেকনাফের মতো একটি ছোট উপজেলায় এত বড় বড় অঙ্কের লেনদেন সন্দেহজনক। বিভিন্ন সময় তদন্তে এবং আসামি ধরতে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছি যে, এত বড় বড় লেনদেন কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কারা করছে—বিষয়টি আরও ভালোভাবে নজরদারি করার জন্য।’

এক সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেক সময় দেখেছি মাদক কারবারিরা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট। সে শুধু মাদকের টাকাই লেনদেন করছে। তাই এজেন্ট ব্যাংকিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সতর্ক হওয়া উচিত।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি টেকনাফ এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণে। আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও অস্বাভাবিক এ অর্থপ্রবাহ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ টেকনাফে লবণ, সুপারির ব্যবসা এবং বন্দরকেন্দ্রিক কিছু বাণিজ্য হয়। কিন্তু সেগুলোর তুলনায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হচ্ছে অনেক বেশি।

টেকনাফ এলাকার একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক পাচার শেষে পুরো প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শুধু টেকনাফ নয়, কক্সবাজার, নাইক্ষ্যংছড়ি বা মিয়ানমার সীমান্তের যে কোনো জেলা থেকেই মাদক সরবরাহ করা হোক না কেন, তার মূল্য মোবাইলের মাধ্যমে টেকনাফের এজেন্টদের কাছেই আসে। সেজন্য টেকনাফ কোনো বাণিজ্যিক বা গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা না হয়েও মোবাইল লেনদেনে প্রায়ই সারা দেশে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্বাহী পরিচালক মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘টেকনাফ উপজেলায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদক চোরাচালানে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হচ্ছে—এ বিষয়ে আমরা অবগত নই। বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে সামনে এলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করব।’

তথ্যসূত্র : দৈনিক কালবেলা 




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top