যমুনায় পানি বাড়লেই আতঙ্ক, শহর রক্ষা বাঁধের উপর আস্থা হারিয়েছে সিরাজগঞ্জবাসী

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১ জুন ২০২২ ০৩:৫০; আপডেট: ১৫ মে ২০২৪ ১১:১৫

ছবি: সংগৃহীত

যমুনা নদীতে প্রতি বছর বর্ষার সময় পানি বৃদ্ধি পেলেই বেড়ে যায় আতঙ্ক। বারবার ধসের কারণে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না শহরবাসী। ১০০ বছরের স্থায়িত্বের এ বাঁধ ইতোমধ্যেই একাধিবার ধসে পড়েছে যমুনার গর্ভে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৯ জুন সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ১৫০ মিটার ধসে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে শহরবাসী। এলাকাবাসী বাঁধের ধ্বসের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তরা দায়ী করেছেন নদীর গতি প্রকৃতি ও বাঁধ নির্মাণকালীন ক্রটিকে।

সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষায় ১৯৯৭ সালে নির্মাণ করা হয় শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্ট। বাঁধটি নির্মাণ করে দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই লিমিটেড। তারা ১০০ বছরের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করেন বাঁধটির। আর এই বাঁধটি নিয়মিত দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্রক্ষ্মপুত্র রাইড ইনভেনমেন্ট (বিআরই) নামে একটি শাখা স্থাপন করে সিরাজগঞ্জে। বিআরই এর এ শাখা থেকে হাইড্রোগ্রাফি সারভেয়ার দিয়ে প্রতিনিয়ত তদারকি করবে। জরুরি মেরামতের জন্য বাঁধের ওপর ১৪শ ঘন মিটার হার্ড রক মজুদ রাখা হয়। এরপরও গত ২৩ বছরে ৯ বার ভাঙ্গনের শিকার হয় এই বাধটি। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় শহর রক্ষা বাঁধকে শক্তিশালী রাখা ও ভাঙ্গন মেরামতের জন্য।

এর আগে, ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ধস নামে শহর রক্ষা বাঁধে। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই প্রথম দফা ও ১৭ জুলাই দ্বিতীয় দফা হার্ড পয়েন্টে আকস্মিক ধস নামে। পানি কমে গেলে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজ শুরু করা হয় এবং হার্ড পয়েন্টের উত্তরে ড্রেজিং করার জন্য ২ কোটি ৬৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এক বছর যেতে না যেতেই ২০১১ সালের ১৮ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৬ দিনের ব্যবধানে বাঁধের ২৭৫ মিটার এলাকা যমুনাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৮ জুলাই রাতে প্রথম দফায় ৭০ মিটার, ২২ জুলাই রাতে দ্বিতীয় দফায় ১০৫ মিটার ও ২৪ জুলাই রাতে তৃতীয় দফায় ১০০ মিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বাঁধ ভাঙ্গার কারণে সে সময় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।

সর্বশেষ, ২০২১ সালের ২৯ জুন সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ১৫০ মিটার ধস নেমে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে বাঁধ সংস্কারে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্ত ২০১৭ সালে কোনো কারণ না দেখিয়ে এই বিআরই শাখা সিরাজগঞ্জ থেকে চলে যায় সুনামগঞ্জে। ২০১৯ সালে বাঁধের জরুরি কাজের জন্য রাখা ১৪শ ঘন মিটার হার্ডরক চলে যায় বিভিন্ন ক্রসবার বাঁধে। এখনও স্থায়ীভাবে নেই হাইড্রোগ্রাফি সারভেয়ার। যে কারণে অরক্ষিত হয়ে আছে আড়াই কিলোমিটারের শহররক্ষা বাঁধটি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক তদারকি না থাকায় বারবার ভাঙ্গনের কবলে পড়ছে শহর রক্ষা বাঁধটি।

বার বার ধসের কারণে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্টের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে শহরবাসী। যমুনা নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রথম ব্যবস্থা নেয়া হয় ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। তার পর থেকে দীর্ঘ ৮০ বছরে নানাভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে ভাঙ্গন ঠেকাতে। ইতিমধ্যে চারটি ক্রসবাঁধও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু যমুনার পশ্চিম দিকের আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তাতে বার বার ধস নামছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, যমুনা নদীর গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে এই হার্ড পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়েছিলো। আগামী ১শ বছরের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে এই বাঁধের ডিজাইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। মূলত, বর্তমানে এ বাঁধটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বাঁধ ভাঙ্গার আতঙ্কে থাকেন সিরাজগঞ্জবাসী।

সিরাজগঞ্জ স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহব্বায়ক নব কুমার কর্মকার যমুনা নিউজকে বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে শহর রক্ষা বাঁধের মেরামত বাবদ কয়েক দফায় বরাদ্দ হয় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। তবুও শহর রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গন থামছে না। বর্ষা এলেই আতঙ্কে থাকেন পুরো জেলাবাসী। বাঁধ দেখভালের জন্য নেই কোনো হাইড্রোগ্রাফি সারভেয়ার। বিআরই’র শাখা চলে গেছে ৫ বছর আগে। একটি হার্ডরকও নেই বাঁধের উপর। তাই সঠিক পরিকল্পনা আর তদারকির অভাবে এ বিশাল বরাদ্দের সিংহভাগ লুটপাট হয়েছে বলে আমরা মনে করছি।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম যমুনা নিউজকে বলেন, ২০২১ সালের ২৯ জুন শহর রক্ষা বাঁধে ধস নামে। বাঁধটি সংস্কারের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বাকিতে কাজ চলছে। বাঁধের ধসের জন্য নির্মাণকালীন ক্রটিকে দায়ী করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহী বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল হক বলেন, কী কারণে এই বিআরই শাখা ও হার্ডরক চলে গেছে তা আমরা জানি না। তবে বরাদ্দকৃত একটি পয়সাও লুটপাট হয়নি বরং জেলাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করেছে এসব প্রকল্প, যা এখন দৃশ্যমান। আর বর্তমানে শহর রক্ষা বাঁধ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে, মেরামতের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শহরবাসীর ভয়ের কিছু নেই বলেও জানান তিনি।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top