বিড়াল প্রেমীদের জন্য সতর্কবার্তা: প্যারাসিটামল হতে পারে প্রাণঘাতী!

মোঃ রোকনুজ্জামান | প্রকাশিত: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:১২; আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ১০:২৬

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান সময়ে পোষা প্রাণীর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে বিড়াল। একটা সময়ে বিড়াল পালন ধনীদের বিলাসিতার বস্তু হলেও বর্তমানে বিড়াল পালন সবার কাছেই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এখন থেকে পাঁচ -দশ বছর আগেও বাংলাদেশে এত জনপ্রিয় ছিল না বিড়াল পালন। কিন্তু বর্তমান সময়ে পোষা বিড়াল তরুণ তরুণী সহ সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অধ্যয়ন রত শিক্ষার্থীদের কাছে এটা একটা বড় ধরনের আবেগের জায়গা।

বিড়াল এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণে বিড়ালের প্রতি তরুণদের মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। যেমন তারা মাঝে মাঝে তাদের মেজাজ পরিবর্তন করে, কখনো শান্ত থাকে, আবার কখনো খেলাধুলায় মেতে উঠে।

এছাড়া বিড়ালের আচরণে রহস্যময়তা থাকে । বিড়ালের এই বৈচিত্র্যময় আচরণ তরুণ তরুণীদের কাছে কৌতুহল ও আকর্ষণ তৈরি করে। যদিও বিড়াল একটি স্বাধীনচেতা প্রাণী,তবুও তাদের মধ্যে একধরনের স্নেহশীলতা থাকে। একাকীত্ব দূর করতে বা মানসিক প্রশান্তির জন্য অনেকেই বিড়ালের সান্নিধ্য পছন্দ করে ।

একটা গবেষণায় উঠে এসেছে যে , নিয়মিত বিড়ালের সান্নিধ্য মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। উপরন্তু বর্তমানে পোষা বিড়াল জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের প্রভাব ব্যাপক। বিড়াল এর কোমল মখমল শরীর, চকচকে চোখ তরুণদের মন জয় করে এবং বিড়ালের খেলাধুলা ও অন্যান্য মজার মজার আচরণের ছবি , ভিডিও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচুর পরিমাণে শেয়ার হওয়ার কারণে পোষা বিড়ালের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিড়াল পালনে কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো জানতেই হবে, না জানলে আপনার প্রিয় পোষা বিড়ালের জীবননাশের শংকা থেকেই যায়। যেমন আমাদের এই সমাজে যারা বিড়াল লালন পালন করে অনেক সময় দেখা যায় তার প্রিয় পোষা বিড়ালটি হঠাৎ করেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আগের মত চঞ্চলতা নেই, একটু কেমন যেন নির্জীব হয়ে গেছে তবে এটি বিভিন্ন কারণেই হতে পারে।

কিন্তু বিপত্তি টা বাঁধে এখানেই। অনেকেই এই অসুস্থ অবস্থায় বিড়াল কে সুস্থ করার জন্য বাসায় থাকা বাচ্চাদের নাপা সিরাপ বা প্যারাসিটামল খাইয়ে দেন এবং আশা করেন যে বিড়াল সুস্থ হয়ে যাবে। তিনি এটা ভালো মনে করেই করেন। কিন্তু না, পরক্ষণেই দেখতে পান বিড়াল সুস্থ তো হলোই না বরং আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এবং এই সময় অবস্থা খারাপ দেখে স্থানীয় গরু ছাগলের ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় , কিন্তু সে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। অগ্যতা তখন উপায় অন্তর না দেখে নিয়ে আসেন রেজিস্ট্রার্ড ভেটেরিনারিয়ানের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে আপনার পছন্দের প্রিয় বিড়াল টি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় এবং সেই মূহূর্তে বাঁচানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

কারণ ততক্ষণে প্যারাসিটামল টক্সিসিটি শুরু হয়ে গেছে। কারণ এই প্যারাসিটামল বিড়ালের শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করে।তাই বিড়াল প্রেমীদের এই ব্যাপারে অবশ্যই জানাশোনা থাকা উচিত এবং এই অবলা প্রাণীদের প্রতি এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত এছাড়াও যারা বিড়াল লালন পালন করে না তাদের ও জানাশোনা থাকা উচিত এই ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য।

কেন প্যারাসিটামল বিড়াল এর জন্য বিষাক্ত?

প্যারাসিটামল বা এসিটামিনোফেন একটি জনপ্রিয় ঔষধ , যা মানুষের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর ব্যাথা নাশক ও জ্বর কমানোর ঔষধ। কিন্তু বিড়ালের জন্য এটি বিষাক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিড়ালের যকৃতে (Liver)প্যারাসিটামল বিপাকের জন্য যে এনজাইম দরকার হয় তা অনুপস্থিত। 'Cytochrome P450' নামক এই এনজাইম মানুষের যকৃতে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকায় প্যারাসিটামল মানবদেহের জন্য নিরাপদ কিন্তু বিড়াল এর জন্য বিষাক্ত। এছাড়া বিড়ালের যকৃতে UDP-glucuronosyltransferase (UGT) এনজাইমের পরিমাণ অত্যন্ত কম এজন্য তারা glucuronidation pathway ব্যবহার করে প্যারাসিটামল ভাঙতে পারে না, তাই বিড়ালের শরীরে প্যারাসিটামল দীর্ঘসময় থেকে যায় এবং বিষক্রিয়া তৈরি করে। প্যারাসিটামল বিপাকের সময় বিড়াল এর শরীরে NAPQI (N-acetyl-p-benzoquinone imine) নামক বিষাক্ত উপজাত (toxic metabolite) তৈরি হয়, এবং এই উপজাত মানুষের শরীরে গ্লুটাথায়োন দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় কিন্তু বিড়ালের শরীরে গ্লুটাথায়োনের পরিমাণ অত্যন্ত কম ।

ফলে এই বিষাক্ত উপজাত জমতে থাকে এবং রক্তে মিশে যায় এবং যকৃত ও রক্ত কণিকা ধ্বংস করে।ফলে মিথেমোগ্লোবিনেমিয়া (Methemoglobinemia)নামক অবস্থার সৃষ্টি হয়, ফলশ্রুতিতে বিড়ালের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায় এবং মিউকাস মেমব্রেন(যেমন দাঁতের মাড়ি, চোখের কনজাঙ্কটিভা, জিহ্বা)নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।এই বিষাক্ত উপজাত(toxic metabolite) টি যকৃতের কোষ (Liver cell)ধ্বংস করে Hepatotoxicity ঘটায়।ফলে কিডনির কার্যকারিতা কমে যায় এবং বিষাক্ত পদার্থ শরীরে জমতে শুরু করে ,যা মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে।

প্যারাসিটামল টক্সিসিটি হলে কী কী লক্ষণ দেখা যায়?

১.মুখ ফুলে যায় এবং অতিরিক্ত লালাক্ষরণ হতে থাকে।
২.বমি করে।
৩.খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়।
৪.শ্বাসকষ্ট হয়।
৫.শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়।
৬.মিউকাস মেমব্রেন নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।

এই অবস্থায় যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয় তাহলে ২৪-৭২ ঘন্টার মধ্যে বিড়ালের মৃত্যু হবার সম্ভাবনা রয়েছে।তাই ভুলবশত বা না জেনে যদি বিড়াল কে প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়ে থাকে তাহলে অতি দ্রুত একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এবং যারা বিড়াল লালন পালন করে তাদেরকে অবশ্যই এটা মাথায় রাখতে হবে যে,একজন রেজিস্ট্রার্ড ভেটেরিনারি প্রাকটিশনারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া পোষা বিড়ালের শরীরে কোন ঔষধ প্রয়োগ করা যাবেনা।

এছাড়া আমরা যারা বিড়াল লালন পালন করি না তাদেরকে ও এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন যাতে আমাদের আশেপাশের কেউ অজ্ঞাতসারে এই ভুলটি না করে ফেলে।এই ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।কারণ বিড়াল শুধু পোষা প্রাণীই নয় এটা একটা সামাজিক জীব যা মানুষের বাসা বাড়ীতেই থাকে। তাদের প্রতি আমাদের সবাইকে যত্নশীল হওয়া উচিত।

লেখক: ইন্টার্ন চিকিৎসক, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল সাতক্ষীরা।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top