মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়

রাজশাহী পুলিশ লাইনের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ

মাহবুব সিদ্দিকী | প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:৪৭; আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:০০

শহীদ হাবিলদার রমজান আলী শেখ,শহীদ কন্সটেবল জাকির হোসেন, শহীদ এসআই দিলশাদ বিশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহী তথা সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইনের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সাথে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। এ সকল ঘটনা সমূহ জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রামী জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তোলে। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পরে।

রাজশাহী পুলিশ লাইন সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মনের মধ্যে কাজ করেছিল। এ সকল কারণে আগে থেকেই রাজশাহী পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। কয়েকটি বাংকারও তৈরি করা হয়।
এই ঘটনার ২ দিন পূর্বে অর্থাৎ ২৩ মার্চ রোহনপুরে একটি ঘটনা ঘটেছিল যার প্রতিক্রিয়া রাজশাহীতেও লক্ষ্য করা গেছে। রোহনপুর সীমান্ত ফাঁড়িতে কর্তব্যরত বাঙালী ও অবাঙালী ই.পি.আর-দের মধ্যে ঐ দিন গুলি বিনিময় হয়। সে দিন রাতে একজন অবাঙালী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য রোহনপুর ই.পি.আর ক্যাম্পের দিকে আসার চেষ্টা করলে বাঙালী হাবিলদার মোঃ আক্কাসের নেতৃত্বে বাঙালী ই.পি.আর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এতে ক্যাপ্টেন তার বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসারণ করে। ২৪ মার্চ এই ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য মোঃ ইউসুফ নামে একজন অবাঙালী সুবেদার রোহনপুরে আসলে তিনি বাঙালীদের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হন। এই ঘটনার প্রভাব রাজশাহীর ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার ও উপশহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যেও ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করা গেছে।
২৫ মার্চ রাজশাহী শহরে সেনাবাহিনীর সাথে পুলিশের বাঙালী হাবিলদার আবুল কাশেম সহ কয়েকজন পুলিশ কনষ্টবল টহল ডিউটী করছিলেন। এক পর্যায়ে টহলরত সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সাথে হাবিলদার আবুল কাশেমের বাক-বিতন্ডা হলে সেনাবাহিনীর অবাঙালী হাবিলদার তাকে বেত্রাঘাত করে। হাবিলদার আবুল কাশেম পুলিশ লাইনে ফিরে এসে এই ঘটনা জানালে পুরা পুলিশ লাইন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি রোহনপুরের পর্যায়ে যাতে না গড়ায় সেজন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী পুলিশ লাইনের তৎকালীন অবাঙালী আর.আই (রিজার্ভ ইন্সপেক্টর) মাজহার খানকে তাৎক্ষণিকভাবে সারদা পুলিশ একাডেমীতে পাঠিয়ে দেন।

সেই রাত্রে রাজশাহী পুলিশ লাইনের চারপাশে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে সারারাত পালাক্রমে সকলেই ডিউটি করেন। সেনাবাহিনী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ২৫ মার্চ রাত্রে রাজশাহী শহরে টহল দিয়েছিল। পাক বাহিনী সে রাত্রে ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার কিম্বা পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেনি। পাক বাহিনীর এই টহলকারী দলগুলো সে রাত্রে শহরের নিরাপরাধ কয়েকজন নাগরিককে নির্দয় ভাবে হত্যা করে। এদের মধ্যে এ্যাডভোকেট নাজমুল হক সরকার এম.এন.এ, হাসানুজ্জামান খোকা, সাইদুজ্জামান মিনা, শহীদুজ্জামান বাবু, ওয়াসিমুজ্জামান, আব্দুল হক, আব্দুর রাজ্জাক ও আফজাল মৃধা উল্লেখযোগ্য। এই হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ২৬ মার্চ সকাল বেলাতেই শহরময় ছড়িয়ে পরে। শহরের নিরীহ নাগরিকগণের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হলেও অনেক পাড়া মহল্লায় সকাল থেকেই সাহসী ছাত্র, জনতা বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে শুরু করেন। এ কাজে সাদা পোশাকের অনেক পুলিশ ও ই.পি.আর সদস্যগণও ছিলেন।

২৩ মার্চের পর থেকে রাজশাহীর ই.পি.আর সেক্টর হেড কোয়ার্টার পাঞ্জাবী এবং অবাঙালী অফিসার ও জোয়ানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেখানে বাঙালী অফিসার বা জোয়ানদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু পুলিশ লাইনের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২৩ মার্চ থেকেই পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার ছিল বাঙালী এন.সি.ও এবং সিপাহীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সে সময় অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার রমজান আলী। সে সময় পুলিশ লাইনের মূল নেতৃত্বে চলে আসেন হাবিলদার আতিয়ার রহমান। তিনি অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন এবং পুরা পুলিশ লাইন তাঁর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

(প্রথম পর্ব সমাপ্ত। লেখকের অনুমতি ক্রমে প্রকাশিত) 

লেখক : মাহবুব সিদ্দিকী

বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক।   

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top