দেশের ৭৫ শতাংশ ভূমিতে উর্বরতা ঘাটতি

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৯; আপডেট: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৫১

ছবি: সংগৃহিত

আবাদি ভূমির পাশাপাশি কমছে ভূমির উর্বরতা। ফলে প্রত্যাশিত ফলনও পাচ্ছে না কৃষকরা। পুষ্টি উপাদানর অপর্যাপ্ততায় ভুগছে কৃষিজমি। কমছে। অনুর্বর জমির পরিমাণও বাড়ছে। সরকারি এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন উর্বরতা ঘাটতিতে ভুগছে। এ অনুর্বর হয়ে পড়া জমির পরিমাণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। খবর টিবিএসের।

মাটির উর্বরতা শক্তি অক্ষুণ্ন থাকতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, বোরন ও জিংক। মাটিতে এসব উপাদানের যেকোনোটির উপস্থিতি পর্যাপ্ত না হলে উৎপাদন ঘাটতি ও খাদ্যের গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনুর্বর ভূমি থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন না পেয়ে কৃষকরা এখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এতে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর উপাদানগুলো বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ।

মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০০০ সালে দেশে উর্বরতার ঘাটতিযুক্ত জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর। পরের ২০ বছরে আরো প্রায় এক লাখ হেক্টর ভূমি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে দেশে উর্বরতা বা পুষ্টি ঘাটতিযুক্ত ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ১১ লাখ হেক্টরে, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে মাটিতে পুষ্টির ঘাটতিজনিত ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ অঞ্চলে।

২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের ৪৫০টি উপজেলার তথ্য নিয়ে এ গবেষণা চালায় এসআরডিআই। গবেষণায় মাটির উর্বরতা বা পুষ্টি গুণাগুণ নির্ধারণের জন্য ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক ও বোরনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৪৫ হাজারেরও বেশি নমুনা পয়েন্ট থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ভূমিতে পুষ্টির গুরুতর ও অতি গুরুতর ঘাটতি রয়েছে, যা মোট ভূমির ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ ভূমিতে পুষ্টির মাঝারি ও নিম্ন ঘাটতি রয়েছে।

এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতি রয়েছে দেশের ৭৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর ভূমির, যা মোট ভূমির প্রায় ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৬৬ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর বা ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ জমিতে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ জমির। এছাড়া জিংকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৮০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভূমিতে। আর বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর বা প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমিতে।

‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক এ গবেষণা পরিচালনা করেন এসআরডিআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মো. জাহিদ, মো. আলতাফ হোসেন, নীলিমা আক্তার কহিনূর এবং সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন মো. শোয়াইব। গবেষকরা বলছেন, মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে ভূমির পুষ্টি ঘাটতি রোধ করা সম্ভব। এছাড়া ভূমিতে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জৈব সারের প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

গবেষণা দলের মুখপাত্র আমীর মো. জাহিদ বণিক বার্তাকে বলেন, মাটির পুষ্টি উপাদানের প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ। ফসফরাস টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি বীজের অঙ্কুরোদ্গম, চারা রোপণ, মূল, অঙ্কুর ও বীজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর পটাশিয়াম রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশের সহায়তা করে সালফার। এ উপাদানটির ঘাটতি দেখা দিলে ফসলের পরিপক্বতার সময় বেড়ে যায়, মানও কমে যায়। আর বোরন উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর গঠন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখে। আবার এগুলোর অভাব পূরণ করতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত সার ব্যবহার করা হয়, তাহলে পরিবেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফসফরাস ও পটাশিয়াম পানিতে মিশে গিয়ে মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়। আবার বোরন শিশুদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।

ভূমির পুষ্টি ঘাটতির প্রতিকার সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্তিকার পুষ্টির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। মাটির জৈব পদার্থের অবচয় নিয়ন্ত্রণে মাটিতে জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমে জৈব পদার্থ যুক্ত করতে হবে। গাছ বা ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়া শস্যের পাশাপাশি একই স্থানে পশু পালন করলে তাদের গোবরের মাধ্যমে জৈব পদার্থের ঘাটতি দূর করা সম্ভব।

গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত—এ ২০ বছরে ভূমির পুষ্টি উপাদানের প্রায় সবক’টিরই অবনতি হয়েছে। এ সময়ে ফসফরাসের ঘাটতি বেড়েছে ১২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে। পটাশিয়ামের ঘাটতি বেড়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ১১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বেড়েছে সালফারের ঘাটতি। জিংকের ঘাটতি বেড়েছে ২৪ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বেড়েছে বোরনের অভাব। এছাড়া ভূমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর বা প্রায় ৭৮ দশমিক ৭০ শতাংশ জমিতে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু তাহের মো. শামছুদ্দোহা বণিক বার্তাকে বলেন, পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে যদি কোনো একটি উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণ না থাকে, তাহলে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে। এর মধ্যে কোনো একটি উপাদান যদি আমরা প্রয়োজনের তুলনায় ১০০ গুণও বাড়িয়ে দিই আর আরেকটি উপাদান অপর্যাপ্ত থাকে, তাহলে ওই অপর্যাপ্ত উপাদানটিই ফলনের পরিমাণ নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ সব উপাদানই পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে। এছাড়া মাটির পুষ্টি ঠিক রাখতে আমরা সার ব্যবহার করি। এর ফলে ফলন বাড়ে কিন্তু ফলনের গুণগত মানে প্রভাব ফেলে। যেমন স্বাদ কমে যাবে। বর্তমানে প্রচুর মাছ চাষ হয়। কিন্তু আগের মতো স্বাদ পাওয়া যায় না। তবে চাষের পরিমাণে অবনতি হবে না। আমাদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সে হিসেবে প্রধান লক্ষ হচ্ছে চাষের পরিমাণ বাড়ানো। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব উপাদানের ঘাটতি পূরণ করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে একদিকে চাষের যেমন খরচ বাড়ছে আবার পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যে মারত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে। নাইট্রোজেন যদি ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়, তাহলে তা মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। আবার ফসফরাস বেশি দেয়া হলে তা বৃষ্টির পানিতে বা বন্যায় খালের পানিতে মিশে যায়। এর ফলে প্রায়ই মাছ মারা যেতে দেখা যায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে তা ঝুঁকি তৈরি করছে।

মাটির উর্বরতা সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোয়। এখানকার বেশির ভাগ ভূমিতেই গুরুতরভাবে উর্বরতার ঘাটতি রয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের মোট ভূমির ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ এলাকা ফসফরাস, ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ পটাশিয়াম, ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ সালফার, ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ জিংক ও ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ এলাকায় বোরনের গুরুতর এবং অতিগুরুতর ঘাটতি রয়েছে। মধ্যম ও স্বল্পমাত্রার ঘাটতি হিসেবে আনলে এর পরিমাণ আরো বাড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহে এসআরডিআইয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শওকতুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরীসহ এ অঞ্চলের নদীর তীরবর্তী নতুন চর এলাকায় বোরনের অতিমাত্রায় ঘাটতি রয়েছে। আবার এক ফসলের জায়গায় একাধিক ফসল চাষের কারণে মাটির ওপর চাপ পড়ছে। এসব জমিতে সালফারের ঘাটতি রয়েছে। মাটির পুষ্টি উপাদান কমে যাওয়ায় কৃষকদের উচ্চমাত্রায় সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফসল বা শাক-সবজি চাষাবাদ করতে হয়। এছাড়া এ অঞ্চলের পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশের মাটিতে চুন ও ক্ষারের (পিএইচ) মাত্রা কম থাকে। ফলে এসব স্থানের মাটিতে ফসফরাস অতিমাত্রায় কম থাকে। এর বিপরীতে আর আয়রনের পরিমাণ বেশি।

মাটির পুষ্টিগুণ কমে যাওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দূরদর্শিতার অভাব ও উদাসীনতাকে দায়ী করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ভূমির পুষ্টি ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ এসব বিষয় নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয় না। অধিক খাদ্য ফলাতে গিয়ে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত দিয়ে কেমিক্যাল ও সার ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের প্রয়োজন ছিল নিজস্ব জাত দিয়ে সার ও কেমিক্যাল ছাড়া উৎপাদন করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বেশি খাওয়াতে গিয়ে সরকার মানুষকে অনিরাপদ খাবার তুলে দিচ্ছে।

মাটির পুষ্টি উপাদান ঠিক রাখতে আরো জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকলে কোন এলাকায় কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, তার নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে আসলে কৃষকরা সেগুলো মানছেন না। ফলে এগুলো ভূগর্ভস্থ পানি বা খাল-বিল, নদী-নালায় মিশে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সারের অপব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top