ভোগ্যপণ্যের সরকারি দর নির্ধারণে বেশি সুরক্ষা পাচ্ছেন আমদানিকারকরা

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪২; আপডেট: ৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪৫

ছবি: সংগৃহিত

দেশের দ্রব্যমূল্যের টাল-মাটাল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তারা। অন্যদিকে, এমন পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছে আমদানিকারকরা। খবর বণিক বার্তার।

ইতিহাসের সর্বোচ্চ দর ওঠার পর বিশ্ববাজারে সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের দাম অনেকটাই স্থিতিশীল। প্রতি সপ্তাহেই কমছে পণ্যটির বৈশ্বিক বুকিং দর। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। এতে আমদানিকারকরা লোকসান এড়িয়ে লাভের ধারায় থাকলেও ন্যায্যমূল্যে পণ্যটি পাচ্ছে না সাধারণ ক্রেতারা। ফলে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক কমলেও খুচরায় সে প্রভাব পড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বেঁধে দেয়া দামের কারণে আমদানিকারকরাই এখন সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা পাচ্ছে।

ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে দাম কমাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক মাস এমনকি দেড় মাস পর্যন্ত সময় নেয়। যদিও পণ্যের দাম বাড়লে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সর্বশেষ চিনির ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি মিলগুলোর প্রস্তাবে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক দফায় দাম বাড়ানোর পর দুই সপ্তাহেরও কম ব্যবধানে ৬ অক্টোবর ফের বাড়ানো হয়েছে নিত্যপণ্যটির দাম। সরকারি মিলের চিনি অবশ্য আগের দামেই অর্থাৎ ৭৫ টাকা কেজিতেই বিক্রি হচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষণ ও ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, বোতলজাত সয়াবিনের দাম গত ২৩ আগস্টের পর ৩ অক্টোবর পুনর্নির্ধারণ করা হয় লিটারপ্রতি ১৭৮ টাকা। এক লাফে পণ্যটির দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও তখন পাম অয়েলের দাম কমানো হয়নি। অথচ দেশের প্রধান পাইকারি বাজারগুলোতে গত কয়েক মাসের তুলনায় পাম অয়েলের সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছিল। ফলে সরকারিভাবে দাম না কমানোয় খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ৮ টাকা কমিয়ে ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দুটি পণ্যের দাম দুই দফায় কমানোর কারণে বাজারে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার এক মাসে একবার দাম কমায় কিংবা বাড়ায়। ফলে সর্বশেষ ৩ অক্টোবর সয়াবিনের দাম কমানো হলেও পাম অয়েলের দাম আপাতত কমছে না বলেই ধরে নিয়েছিলেন পাইকারি ব্যবসায়ী, ডিলার, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান কিংবা এসও (সরবরাহ আদেশ) ব্যবসায়ীরা। যার কারণে কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে বড় অংকের পাম অয়েল ও সুপার পাম অয়েলের লেনদেন হয়েছে। এখন হঠাৎ করেই দাম কমিয়ে দেয়ার কারণে পাইকারি পর্যায়ে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়বেন ব্যবসায়ীরা, যার নেতিবাচক প্রভাব খুচরা পর্যায়েও পড়বে বলে মনে করছেন তারা।

শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের মে মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল টনপ্রতি ৫৭৬ ডলার। একই বছরের ডিসেম্বরে পাম অয়েলের দাম বেড়ে ১ হাজার ১৬ ডলারে উন্নীত হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পণ্যটির লেনদেনের গড় ছিল ১ হাজার ২৭০ ডলার, যা ২০২২ সালের মার্চে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১ হাজার ৭৭৬ ডলারে উঠে যায়। তবে চলতি বছরের জুলাইয়ে টনপ্রতি দাম কমে ১ হাজার ৫৬ ডলার এবং সর্বশেষ চলতি মাসে ৭৮৭ ডলারে নেমে আসে। অন্যদিকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অপরিশোধিত সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১ হাজার ৫৯৫ ডলার। মার্চে দাম বেড়ে ১ হাজার ৯৫৬ ডলার, এপ্রিলে ১ হাজার ৯৪৭ ডলার, মে মাসে রেকর্ড ১ হাজার ৯৬২ ডলারে উন্নীত হয়। জুনে দাম কিছুটা কমে ১ হাজার ৭৫১ ডলার, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৩৩ ডলার এবং বর্তমানে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম নেমে এসেছে ১ হাজার ৪৯০ থেকে ১ হাজার ৫২১ ডলারে।

চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক আমদানি মূল্যের হিসাবে ওই সময়ে দেশে সয়াবিনের দাম ছিল লিটারপ্রতি (বোতলজাত) যথাক্রমে ১৬০, ১৯৮ ও ২০৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে দাম দেড় হাজার ডলারের মধ্যে স্থিতিশীল থাকলেও শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণ দেখিয়ে সয়াবিনের বোতলজাত দাম ১৯২ টাকা আটকে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। সর্বশেষ ৩ অক্টোবর সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে ১৭৮ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। যদিও কয়েক দিনের ব্যবধানে পাম অয়েল বা সুপার পাম অয়েলের দাম ৮ টাকা কমিয়ে ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিশ্ববাজার থেকে আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মুনাফা বলে দাবি করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

ভোক্তা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্থিতিশীলতার আগে দেশে লিটারপ্রতি সয়াবিনের দাম ৯২-১০৫ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ দাম উঠলে দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে টনপ্রতি দাম প্রায় ৫০০ ডলার কমলেও শুধু ডলার সংকটের অজুহাতে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কমানো হচ্ছে ধীরগতিতে। এমনকি বর্তমান নিম্নমুখী বিশ্ববাজার থেকে বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন দামে পণ্যটি সংগ্রহ করলেও সরকারি বেঁধে দেয়া দামের কারণে ঠকছে ভোক্তা।

বেসরকারি পর্যায়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর চিনির দাম খোলা অবস্থায় কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা এবং মোড়কজাত অবস্থায় সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ট্যারিফ কমিশন। যদিও এ বর্ধিত দামও মেনে নিতে পারেননি বেসরকারি মিল মালিকরা। অক্টোবরের শুরুতে নতুন করে চিনির দাম বাড়াতে ফের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। এরই মধ্যে বেসরকারি মিলের চিনির মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে চিনির মণপ্রতি দাম ৪-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। ৬ অক্টোবর বেসরকারি রিফাইনারি মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিনির দাম খোলা অবস্থায় কেজিপ্রতি ৯০ টাকা এবং মোড়কজাত অবস্থায় কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বর্তমানে মিলগেটে প্রস্তুত পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকা মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি)। এছাড়া সুপার পাম অয়েল ৪ হাজার ৫০০ টাকা মণে লেনদেন হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে মিলগেট থেকে সংগ্রহ করে একই পণ্য মণে ২০০-২৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া এসও পর্যায়ে মণপ্রতি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১৮০ থেকে ৩ হাজার ১৯০ টাকা দরে। একই চিনি মিলগেট থেকে সংগ্রহ করার পর পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৩৫০ টাকায়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলার সংকটের কারণে ভোজ্যতেলের বাজার আশানুরূপ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। আমদানিকারকদের প্রস্তাব পর্যালোচনার পর ট্যারিফ কমিশন যুক্তিসংগত কারণ ব্যাখ্যা করে ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করছে। ফলে কেউ বেশি দামে পণ্য কিনলেও বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ নেই। ভোগ্যপণ্য খাতে ব্যবসায়ীদের বড় বিনিয়োগ থাকায় নির্ধারিত দাম পদ্ধতির কারণে এককভাবে বড় লোকসানের সুযোগও কমে এসেছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তাদের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দেয়া হয় বলে মনে করছেন তিনি।

খাতুনগঞ্জের একাধিক ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে আমদানিকারকরা খোলা ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে অতিমুনাফা করার সুযোগ পান। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাম অয়েলের দাম সম্প্রতি রেকর্ড পরিমাণ কমে গিয়েছে। কিন্তু দেশে সরকার নির্ধারিত দাম থাকায় কোম্পানিগুলো আগের দামেই এসও (সরবরাহ আদেশ) বিক্রি করছে। বাজার প্রতিযোগিতার কারণে চাইলেও কেউ কম দামে পণ্য বিক্রি করছেন না। বাজারকে স্বাভাবিক গতিতে ছেড়ে দেয়া হলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তারা স্বাভাবিক দামে পণ্য সংগ্রহ করতে পারতেন বলেও মনে করছেন তারা।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই পণ্যের দাম বাড়াতে তত্পরতা শুরু করে দেন আমদানিকারকরা। কিন্তু নিম্নমুখী বাজারে খুবই ধীরগতিতে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম কমানো হচ্ছে। এতে আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীদের মুনাফা নিশ্চিত হলেও ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top