অপ্রতিরোধ্য ডেঙ্গু: দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২২ ১৭:১২; আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:২১
-2022-10-09-07-11-52.jpg)
দেশে ব্যাপকহারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এদিকে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ও বাড়ছে। বিদ্যমান ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খবর যুগান্তরের।
যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম করা দরকার তার বড়ই অনুপস্থিতি দেখছেন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বছরজুড়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম না করা, হট স্পটগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে লার্ভা ধ্বংসে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং ‘র্যাপিড ক্রাশ প্রোগ্রাম’ না নেওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি ঘটছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সময়টা ডেঙ্গির প্রজনন মৌসুম। আর এবার ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়বে মৌসুমের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অবহিত করা হয়েছিল। এর পরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যকর তৎপরতার অনুপস্থিতি রয়েছে। যে কারণে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গি পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এই সময়েও ঢাকার দুই সিটির তেমন তৎপরতা নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। অন্যান্য বিভাগের অনেক কর্মকর্তারাও বর্তমানে ছুটিতে রয়েছেন। গত সপ্তাহে ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড চললেও ডিএসসিসির তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র করোনা আক্রান্ত, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও অসুস্থ, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দেশের বাইরে রয়েছেন। এই সময়ে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী ও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত সপ্তাহে তিন হাজার ৪৩১ জন ডেঙ্গিরোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার তিন জনসহ বছরের মৃতের সংখ্যা এখন ৬৭ জনে পৌঁছেছে। গতকাল সর্বোচ্চ ৭১২ জন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট ১৯ হাজার ৫২৩ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৭ হাজার ১৭৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৭৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা চার হাজার ৭৮৫ জন। ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা মোট ১২ হাজার ৯৮১ জন এবং ঢাকার বাইরে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা চার হাজার ১৯৬ জন। মাসভিত্তিক রোগী ভর্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এই বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গিরোগী ভর্তি হয়েছেন সেপ্টেম্বর মাসে। এই মাসে ৯ হাজার ৯১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ৩৩০ জন ডেঙ্গিজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গত মাসে ডেঙ্গিতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দিনে একজনের বেশি রোগী মারা গেছেন। এ ছাড়া আগস্ট মাসে তিন হাজার ৫২১ জন, জুলাই মাসে এক হাজার ৫৭১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। জানুয়ারি মাসে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন এবং জুন মাসে ৭৩৭ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন হাজার ৪৩১ জন। গড় হিসাবে দৈনিক ৪৯০ জন ডেঙ্গিরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গিতে মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর ২১ জুন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। চলতি মাসে ডেঙ্গিতে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, এই বছর ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়বে সেটা জুনে বলা হয়েছে। এখন পূর্বাভাস অনুযায়ী সবকিছুর মিল পাওয়া যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারি তথ্যের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সব তথ্য সরকারি তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে ডেঙ্গির প্রকোপ কমাতে যেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ দরকার ছিল; সেভাবে করা হচ্ছে না। এজন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গির প্রকোপ যে মাত্রায় বেড়েছে, এখন প্রয়োজন ‘র্যাপিড ক্রাশ প্রোগাম’ পরিচালনা করা। ‘হট স্পট’গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো ধ্বংসে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সে ধরনের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এখন রাজধানীর ঢাকার ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এসব এলাকা থেকে আশপাশের জেলায়।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাক্টাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম হচ্ছে ‘ঘায়ে মলম লাগানোর মতো’। সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার পর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যদিও সেসব পদক্ষেপে তেমন কোনো সুফল মিলছে না। এখনো দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে ডেঙ্গি ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো গুরুত্ব বা তাগিদ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এজন্য ডেঙ্গি সমস্যার টেকসই সমাধান মিলছে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ডেঙ্গির প্রজনন শুরু হয়েছে, এটা আর যাবে না। প্রতি বছর কম-বেশি ডেঙ্গির প্রকোপ থাকবে। এজন্য ডেঙ্গি বা কীট নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের উচিত টেকসই ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া। টেকসই সমন্বিত কীট বা মশক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বাস্তবে রূপ পেল না। সরকারকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রয়োজন টেকসই সমন্বিত কীট নিয়ন্ত্রণ বিভাগ বা কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা। যেই সংস্থার অধীনে বছরব্যাপী কীট বা মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সমন্বয় সভার আয়োজন করে। ওই সভার সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। সেখানে ঢাকার দুই সিটিসহ সব সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডেঙ্গি রোগে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কম। তিনি বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গি ভাইরাস নিয়ে ২০১৯ সালে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলেও ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সাল এই তিন বছর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা সফলতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। বর্তমানে আবার এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। একই সঙ্গে ডেঙ্গিরোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে আমরা এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো আছি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: