দেশের রেমিটেন্সের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৫১; আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৫৩

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ থেকে নানা দেশে যাচ্ছে শ্রমিক। শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্য হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে যেতে শুরু করে প্রবাসীরা। এখনও রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ মধ্যপ্রাচ্য। খবর বণিক বার্তার।

শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশীদের বিদেশ যাত্রার শুরুটা সত্তরের দশকে। ওই সময় বিদেশে বাংলাদেশীদের শ্রমবাজার বলতে ছিল কেবলই মধ্যপ্রাচ্য। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া ছিল বাংলাদেশী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্য। সেটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথা। ধীরে ধীরে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে লেবানন, জর্দান, ইরাক, ব্রুনাইয়ের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ এ দেশগুলো থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে উত্থান-পতন হয়েছে। এর পরও বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস ধরে রেখেছে মধ্যপ্রাচ্য।

বিদেশে বাংলাদেশীদের সর্ববৃহৎ বাজার হলো সৌদি আরব। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশী সংস্থাটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশ গিয়েছেন। এর মধ্যে ৫১ লাখ ৮২ হাজারই গিয়েছেন সৌদি আরবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী শ্রমিকদের ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশের গন্তব্য ছিল সৌদি। পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের প্রধানতম গন্তব্যও মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশটি।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি বা ২১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯০ টাকা দরে)। বিপুল এ অর্থের ২২ শতাংশের উৎস ছিল সৌদি আরব। শুধু সৌদি থেকেই গত অর্থবছরে ৪৫৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে এসেছে। ২০২১-২১ অর্থবছরে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৫৭২ কোটি ডলার। ওই অর্থবছরে দেশে মোট ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। এর মধ্যে সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদান ছিল ২৩ শতাংশেরও বেশি।

সৌদি আরবই শুধু নয়, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ছয়টিই এখনো মধ্যপ্রাচ্যের। এ দেশগুলো হলো—সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরাইন। গত অর্থবছরে দেশে আসা রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশের উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এ ছয় দেশ। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী বাংলাদেশীরা পাঠিয়েছেন ২০৭ কোটি ডলার। কুয়েত প্রবাসীরা ১৬৯, কাতার প্রবাসীরা ১৩৫, ওমান প্রবাসীরা ৯০ ও বাহরাইন প্রবাসীরা ৫৬ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

বাংলাদেশীরা সাধারণত শ্রমিক, গৃহস্থালি কর্মী, টেকনিশিয়ান ও চাকরিজীবী হিসেবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি অংশ বিদেশে গিয়ে ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যের দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কৃষিপণ্য বিক্রিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করছেন বাংলাদেশীরা। আবার কেউ কেউ উদ্যোক্তা হিসবে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন খামারও গড়ে তুলছেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী শিক্ষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের কদরও বাড়ছে।

সৌদি আরবের জেদ্দার গোরাব মার্কেটে ইলেকট্রিক পণ্যের একটি দোকান চালান বাংলাদেশী তরুণ সাইফুল ইসলাম। ওই মার্কেটে প্রায় ৪০০ দোকান রয়েছে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের। এ ধরনের পণ্যের জন্য গোরাব হলো সৌদি আরবের সর্ববৃহৎ মার্কেট। জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, গোরাব মার্কেটে অর্ধশতাধিক দোকানের মালিকানা বাংলাদেশীদের। এসব দোকানে কর্মরত শ্রমিকদের বেশির ভাগই বাংলাদেশী। দোকান মালিকরাও এক সময় শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে এসেছিলেন। সীমিত পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে অনেকে এখন বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন।

শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশীদের বিদেশ যাত্রার দ্বিতীয় বৃহৎ গন্তব্য হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ লাখ ৮৫ হাজার বাংলাদেশী আমিরাত প্রবাসী হয়েছেন। সরকারি সংস্থাটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশগামী বাংলাদেশীদের ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটিতে। এর মধ্যে অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তবে এখনো আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।

আশির দশক থেকে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতি। বিশ্বের অতিধনীদের চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে সমাদৃত হতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রেও রূপান্তর হয়েছে আমিরাতের দুবাই শহর। বিশ্বের বৃহৎ করপোরেটগুলো দুবাইয়ে নিজেদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করছে। বাংলাদেশী বড় ব্যবসায়ীদেরও বিনিয়োগ ও অর্থ পাচারের অন্যতম পছন্দের স্থান হিসেবে আরব আমিরাতের নাম উঠে এসেছে। আরব আমিরাত সরকারের দেয়া ‘গোল্ডেন ভিসা’র সুবিধা নিচ্ছে বাংলাদেশী ধনীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশী শ্রমিকদেরও পছন্দের গন্তব্য এখন দুবাই।

২০১২ সাল-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য ভিসা সুবিধা সীমিত করে আরব আমিরাত সরকার। ফলে দেশটিতে শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশীদের গমন সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। এ কারণে আমিরাত থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও কমতে থাকে। ২০২১ সালে করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশীদের ভিসা সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অভিবাসন বেড়েছে। গত বছর ২৯ হাজার বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশে আরব আমিরাত গিয়েছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত গিয়েছেন ৮৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশী।

দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম জানান, আরব আমিরাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হলো নির্মাণ খাত। দেশটির আকাশ সমান উচ্চতার ভবনগুলো নির্মাণে বাংলাদেশী শ্রমিকরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এখনো নির্মাণ খাতেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মী, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মী হিসেবেও বাংলাদেশীদের চাহিদা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আরব আমিরাতের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশীরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ তিন দেশ কুয়েত, কাতার ও ওমানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশী শ্রমিকরা। এর মধ্যে ওমানে গিয়েছেন ১৭ লাখ ১২ হাজারের বেশি কর্মী। আর কাতার অভিবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যাও ৮ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি। ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কুয়েত প্রবাসী হয়েছেন ৬ লাখ ৪৬ হাজার বাংলাদেশী। কর্মসংস্থানের পাশাপাাশি মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশই বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণের অন্যতম উৎস। এর মধ্যে কুয়েত হলো বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের শীর্ষ পঞ্চম দেশ। গত অর্থবছরে কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৬৯ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আর কাতার প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৩৫ কোটি ডলার।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী হয়েছেন জর্দান, লেবানন, ব্রুনাই ও ইরাকে। এর মধ্যে লেবানন ও ইরাকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। গত অর্থবছরে জর্দান প্রবাসীরা ১৪ কোটি ও ব্রুনাই প্রবাসীরা ৫ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব সত্ত্বেও লেবানন থেকে এসেছে ৫ কোটি ডলার। আর ইরাক প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২ কোটি ডলার।

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে মৌলিক ভূমিকা রাখলেও মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশে সামাজিক মর্যাদার দিক থেকেও বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী অন্তত ১০ জন বাংলাদেশী বণিক বার্তাকে বলেছেন, বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। ভিসা কেনা থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই নির্ধারিত অংকের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তাদের ব্যয় করতে হয়েছে। অনেকে নিজের বসতভিটে পর্যন্ত বিক্রি কিংবা বন্ধক রেখে বিদেশ গিয়েছেন। বিদেশে গিয়ে দূতাবাস থেকে যথাযথ সেবা তারা পাচ্ছেন না। পাসপোর্ট নবায়নের মতো সাধারণ সেবা নিতে গিয়েও বাংলাদেশী দূতাবাস কর্মীদের কাছে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top