ইসি আইন ৫০ বছরেও হয়নি

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩১; আপডেট: ৩ মে ২০২৪ ১৯:৩৩

ফাইল ছবি

     #খালেদা জিয়ার আমল থেকেই অধীনের ইসির যাত্রা
      #হুদা কমিশন নিয়মেই ২০২২ সালের ইসি গঠন হচ্ছে
 #৩১টি দলের সাথেই আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপতি
   #অতীতের দুটি সার্চ কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন
      #আইন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বানানোর দাবি

বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন রয়েই গেলো! স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ইসি গঠন নিয়ে আইন তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক ও বিশেষ অঙ্গনে প্রশ্ন রয়েই গেলো নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়ে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সেই পথে হাঁটেনি সরকার। পুরনো নিয়মেই দৃঢ় অবস্থানে।

সমপ্রতি আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠিত হবে। এবারো আইন তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। তারই ধারাবাহিকতায় এবারো নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসা হচ্ছে। দিনক্ষণও ঠিক হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩১টি দলের সাথেই আলোচনা বসবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আগের দুটি কমিশনের মতো এবারো সংলাপের পর একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠন করা হবে।

এ নিয়ে সন্তোষ-অসন্তোষ এখন থেকেই রাজনৈতিক মাঠে চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, অতীতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে হওয়া দুটি নির্বাচনের বৈধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে। দেশের বিশেষ শ্রেণির লোকেরাও রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছেন সার্চ কমিটির মাধ্যমে হওয়া ইসির অনিয়ম নিয়ে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবিও বিশিষ্ট নাগরিকদের। চাওয়া হয়েছে জবাব— নির্বাচনে প্রাণহানি ও অনিয়মের বিষয়ে।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা সরকারের একতরফা নিয়মে ইসি মানে না, আন্দোলনের হুমকিও দেয়া হচ্ছে। তবে অধীনের ইসি যাত্রা খালেদা জিয়ার আমল থেকেই শুরু যা চলমান ক্ষমতাধররাও ব্যবহার করছেন, এমন অভিযোগ বাম নেতাদের। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আগামী সোমবার থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসবেন।

গত বুধবার রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি আগামী ২০ ডিসেম্বর থেকে দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসবেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাথে প্রথম আলোচনা হবে। ১৫ থেকে ২০ দিন এ আলোচনা চলবে।’

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় নেতা মুজিবুল হক চুন্নু জানান, আগামী ২০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণের বিষয়টি জানতে পেরেছেন। তারা তাদের কৌশল ঠিক করছেন।

এক সময়কার ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে— রাষ্ট্রপতি ডাকলেই তারা যাবেন বলে এখনই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না।

উল্লেখ্য, আগামী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইসির পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে। নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে সিইসি এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। গত কয়েকটি মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ‘সার্চ কমিটি’র সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন।

জানা যায়, সংবিধানে একটি আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের নির্দেশনা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোনো সরকার এই আইন করেনি। আইন না হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। তাই দেশের রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নিয়োগ দেন। ২০১২ সালে ইসি গঠনে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনি সবক’টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সংলাপে ডেকেছিলেন।

পরে একটি সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবিত নাম থেকে ইসি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। তবে প্রথমবারের মতো নতুন এই পদ্ধতিতে গঠিত কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন কোনো চমক দেখাতে পারেনি। বরং ২০১৪ সালে একটি ‘একতরফা’ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ওই জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইসির ভূমিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। জিল্লুর রহমানের পদ অনুসরণ করে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ গঠন করেন বর্তমান কে এম নুরুল হুদা কমিশন।

এরপর প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। ওই কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, অনিয়মসহ ৯টি অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তারা এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি দেন রাষ্ট্রপতিকে। তবে এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি।

এ নিয়ে সমপ্রতি গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের নেতারা বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে যে ক’টি নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ কমিশনই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে। স্বাধীনভাবে নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তারা কোনো কাজ করেনি। তাই সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে ইসি গঠনের দাবি জানাচ্ছেন তারা।

গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এম-এল) সাধারণ সম্পাদক হারুন চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া মাগুরার উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগও নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করেছে। নির্বাচন কমিশন শাসক দলের তল্পিবাহক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আইন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করতে হবে। আন্দোলনরত সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।

এ কে এম আলী রেজা নামের এক শিক্ষক বলেন, নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সবার মতামত গ্রহণ করার সৎ সাহস থাকতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন না চায় তাহলে সার্চ কমিটি করে কি কোনো লাভ হবে। বিষয়টি অনেক জটিল।

ব্যবসায়ী কাজী সারাফাজ মাওলা বলেন, কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন ২০১৪ সালে একটি ‘একতরফা’ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ওই জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইসির ভূমিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও আমাদের শীর্ষ কিছু ব্যক্তি বলেছেন, ভোট ও ক্ষমতায় লোভ নেই। তবুও বর্তমান কে এম হুদা কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচনসহ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনেও বিতর্কিত হন। তা ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হুমকি ধামকি, ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ব্যালট ছিনতাই এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা ঘটেনি। কিন্তু ইসি ছিলো হুদাহুদি। আগামী সোমবার থেকে নতুন ইসি গঠনের বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি আবদুুল হামিদ।

বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে কি-না জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে এখনো কিছু বলতে পারব না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘শুনতেছি ইদানীং রব উঠেছে, গণমাধ্যমেও দেখছি যে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হবে সার্চ কমিটি দিয়ে। তবে আমি সার্চ কমিটি কোনোদিন শুনিনি। এই সার্চ কমিটির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। চেষ্টা করলে প্রতিরোধ করা হবে, বাধা দেয়া হবে। সেই বাধার মুখে সরকার টিকে থাকতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন কমিশন তাদের শপথ অনুযায়ী স্বাধীনভাবে দেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা বা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই, থাকবেও না। সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, আইনগতভাবে তারাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট।’

এ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘দেশের নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, কোনো নির্বাচন তো এখন আর সুষ্ঠু হয় না। মানুষ কী এখন আর ভোট দিতে পারে। পরপর দুটি সার্চ কমিটির পারফরম্যান্স মানুষ তো দেখেছে, আমরাও দেখেছি— এ দুটি কমিটির অর্জন সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না। ভোটাররা ভোট দিতে চান না, কারণ তারা মনে করেন, ভোট দিয়ে লাভ নেই।’




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top