গ্রেফতার ও সাজার চাপে বিএনপি নেতাকর্মীরা

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:২২; আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫০

ছবি: প্রতীকী

সরকার পতনের একদফা দাবিতে টানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত ফয়সালা চায় দলটি। তবে হঠাৎ করে নেতাকর্মীদের নামে ‘গায়েবি’ মামলা, গ্রেফতার ও দণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা বেড়ে গেছে। কাজটিকে নির্বাচনের আগে দলকে চাপে রাখার কৌশল ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে কেন্দ্র ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তারা সাজা ও গ্রেফতারের চাপে রয়েছেন।

বিশেষ করে দুর্নীতি, জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাসবিরোধী ও নাশকতার শতাধিক মামলার বিচারে গতি এসেছে। যাকে ‘রাজনৈতিক মামলা’ বলছে বিএনপি। ইতোমধ্যে অনেক নেতার সাজাও হয়েছে। এসব মামলায় আসামিদের তালিকায় বিএনপি মহাসচিবসহ অনেক শীর্ষ নেতাও রয়েছেন। তবে এ নিয়ে চিন্তিত হলেও দাবি আদায়ে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি। চলতি মাসকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ধরে এই সময়ে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সতর্ক থেকে আন্দোলন সফল করাসহ প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে। যাদের কাজ হলো বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও গায়েবি মামলার তালিকা করা। সেখান থেকে নির্দিষ্ট কিছু মামলা দ্রুত বিচার করে সাজা দেওয়ার জন্য আদালতগুলোকে নির্দেশ দেওয়া। কাজটা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবারও ১৫ নেতাকে চার বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনের নামে সরকার যা করছে, তা বেআইনি ও সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনাও দ্রুত বাড়ছে। পুলিশের পাশাপাশি ডিবি এ ব্যাপারে অধিক তৎপর। স্বাভাবিক দলীয় শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, এমনকি গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে আগের কোনো গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজাহারভুক্ত আসামি না হওয়া সত্ত্বেও জামিন দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্তরা নিু আদালতে হাজিরা দিতে গেলেই জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব করে বিরোধীদের আন্দোলন দমানো যাবে না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা নিশ্চিত করার লড়াইয়ে দেশের সংগ্রামী জনগণ অবশ্যই বিজয়ী হবে।’

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কেউ কোনো মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হন। এ কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, মামলার দ্রুত বিচারকাজ শেষ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাজাপ্রাপ্তরা যেন আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখতে ও আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসাবে এই পন্থা নিয়েছে সরকার।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। ঢাকা মহানগরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, ‘সাজা নিয়ে বিএনপি যেসব কথা বলছে তা মনগড়া। আসলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। মামলাগুলো বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। চার্জশিট হয়েছে, সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। সবচেয়ে বড় কথা মামলা যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে তা সবার জন্যই মঙ্গল। নইলে কোর্টে আসা-যাওয়া এটা একটা বিড়ম্বনা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব মামলা নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। যখন একটা অপরাধ ঘটে, তখন এটা তো রাজনৈতিক বলা যাবে না। ভাঙচুর, নাশকতা করলে তাতে মামলা হলে, তা তো রাজনৈতিক বলা যাবে না। তাই স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই মামলার বিচারকাজ চলছে, তাড়াহুড়া হচ্ছে না।’

এদিকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলন দমাতে হঠাৎ করে নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার গভীর রাতেও ধানমন্ডির বাসার দরজা ভেঙে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, গত ২৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি ঘিরে মামলা হয়েছে ৩৪৩টি। আসামি ১৩ হাজার ২৭০ জন এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ২২৫০ জন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত আট মাসে বেশ কয়েকটি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তারা মূলত কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মী। এর মধ্যে আট বছর আগে গুলশান এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) তৎকালীন আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিনসহ তিন বিএনপি নেতাকে কারাদণ্ড দেন আদালত। ১০ বছর আগে সবুজবাগে ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার মামলায় গত ১৯ জুন বিএনপি নেতা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হামিদুর রহমানসহ সাতজনের দুই বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। আর ১০ বছর আগে মুগদা এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় গত ৩ এপ্রিল বিএনপির আরও সাত নেতাকর্মীর কারাদণ্ড দেন আদালত। গত ৭ আগস্ট যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ২১ জনের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানা সংলগ্ন এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগের মামলা ছিল এটি। গত ১৮ আগস্ট রমনা থানার একটি মামলায় আবুল কালাম আজাদ নামে একজন বিএনপি কর্মীকে সাজা দেন আদালত। বনানী থানার একটি মামলায় ৮ অক্টোবর ১০ জন বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। আট বছর আগে ভাটারা থানায় দায়ের করা নাশকতার মামলায় ৯ অক্টোবর ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সহ-গ্রাম সরকার বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব সাবেক এমপি আহসান হাবিব লিংকনসহ ১৫ জন নেতাকর্মীকে ৪ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান দণ্ডিত হয়েছেন। এ ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে ৯ বছর, ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমানকে ১৩ বছর ও তার স্ত্রীকে ৩ বছর, প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে ৭০ বছর, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদকে ৩ বছরসহ যুবদল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর আগে আগে সাতক্ষীরা জেলায় এবং ঈশ্বরদীতে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

জানা গেছে, আরও দুই শতাধিক মামলার শুনানি চলছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টির বিচার শেষ পর্যায়ে। ১৭০টি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আমরা রাজপথে আছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে এক পাক্ষিক নির্বাচন করার জন্য অর্থাৎ বিএনপিকে ছাড়া আগের মতো নির্বাচন করতে চায়। সে কারণে তারা নতুন আরেকটা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে।’

কায়সার কামাল বলেন, ‘পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেখলাম, পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও পুরোনো মামলার সেল গঠন করা হয়েছে। সেই সেলের কাজটা কী, বিএনপির বিরুদ্ধে পুরোনো যেসব মামলা আছে সেগুলো কীভাবে দ্রুত সমাধান করা যায়। সেটা আরেকটা অপকৌশল। সরকার পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। কারণ যে কাজ পুলিশের করার কথা না, সে কাজ পুলিশ করছে বিরোধী দলকে দমন করার জন্য।’



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top