বিএনপির চতুর্থ দফার অবরোধ : ৯ পরিবহনে আগুন, যুবদল নেতা আটক

সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপি ও জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা চতুর্থ দফার টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হয়েছে রোববার ভোর ৬টা থেকে।

ঢাকায় বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কারসহ সব ধরণের যান চলাচল করছে, তবে সেটা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে হরতাল এবং অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি।

ওই সমাবেশের পর ২৯ অক্টোবর হরতাল পালন করে বিএনপি, তাতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো সমর্থন দিয়েছিল।

এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর এবং ৫ ও ৬ নভেম্বর আরো দুই দফা সড়ক-রেল-নৌপথে সর্বাত্মক অবরোধ করে বিএনপি। ওই কর্মসূচির পরে ৮ ও ৯ নভেম্বর তৃতীয় দফা ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ করে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো।

সর্বশেষ রোববার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত তারা চতুর্থ দফার অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।

এই দফা কর্মসূচি শেষে আবার নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।

গত কয়েক দফায় অবরোধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ, পরিবহনে অগ্নি-সংযোগ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে, এসময়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দলটি।

কেমন চলছে চতুর্থ দফার অবরোধ?

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে চতুর্থ দফার এই অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা এই অবরোধ চলবে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্যামা পূজার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছে দলটি।

ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সংখ্যায় কম হলেও সড়কে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ বিভিন্ন ধরণের পরিবহন চলছে।

অফিস শুরুর সময়ে ঢাকার ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর সিগনালে গাড়ির জট তৈরি হলেও, বেশি সময় আটকে থাকছে না। তবে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করছে না।

গাবতলি বাস টার্মিনালে সকাল থেকে মাত্র একটি বাস ছেড়ে গেছে। গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে মাত্র সাতজন যাত্রীকে নিয়ে বাসটি ছেড়ে যায়।

এছাড়া প্রচুর যাত্রী গত দুই দিনের বন্ধে ঢাকায় এলেও এখন ফিরতে পারছেন না।

চুয়াডাঙ্গার একজন বাসিন্দা বলেছেন, ‘আমি জানতাম আজকে অবরোধ। তাও একটা সুযোগ নিতে এসেছি। অপেক্ষা করছি, যদি কোন বাস ছেড়ে যায়, তাহলে চলে যাবো।’

অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে শনিবার ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে যাত্রীর চাপ দেখা গেছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছে বহু মানুষ।

রাত থেকে ৯টি পরিবহনে আগুন

চতুর্থ দফার এই অবরোধ শুরুর আগে শনিবার রাতে ঢাকা ও এর আশেপাশেসহ নয়টি স্থানে যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে বলা হয়, শনিবার রাত ৮টা থেকে রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত ওই আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আটটি বাস, একটি পিকআপ পুড়ে যায়।

এর মধ্যে সাতটি আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মহানগরে। বাকি দু’টি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুর এবং বরিশাল সদরে।

এই অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৯টি ইউনিট ও ১৯৩ জন জনবল কাজ করেছে বলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

আগুন দেয়ার প্রথম ঘটনাটি ঘটে মতিঝিলের আরামবাগে রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে। সেখানে নটরডেম কলেজের বাইরে লাল-সবুজ নামে একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। পরে সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশন থেকে ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে।

এর ১০ মিনিটের ব্যবধানে রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাবতলি বাস স্ট্যান্ডের সামনে আরেকটি বাসে আগুন দেয়া হয়। পরে কল্যাণপুর ফায়ার স্টেশনের দু’টি ইউনিট কাজ করে।

এরপর ৯টার দিকে গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের সামনে একটি বাসে আগুন দেয়া হলে সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের দু’টি ইউনিট অগ্নি নির্বাপণ করে।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার কাছে ফলপট্টির সামনে অনাবিল পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। পরে পোস্তগোলা ফায়ার স্টেশনের দু’টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর ১৪ নম্বরে কাফরুল থানার সামনে প্রজাপতি পরিবহনের বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।

রাত ১২টার দিকে মিরপুরে রূপনগর থানার সামনে আরেকটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

সবশেষ রোববার ভোর ৬টার দিকে ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় মালঞ্চ পরিবারের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে, যা পরে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণে আসে।

এদিকে রাত সাড়ে ৯টার গাজীপুরের জুগিতলায় একটি পিকআপে আগুন ধরানোর ঘটনা ঘটে সেইসাথে বরিশাল সদরে বিভাগীয় পুলিশ কার্যালয়ের সামনে, মা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

শনিবার সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকায় দু’টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। শনিবার সকাল ৭টার দিকে ফার্মগেটের বাবুল টাওয়ারের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

তবে বাসে আগুন দেয়া বা ককটেল বিস্ফোরণ এসব কোন ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

যুবদল নেতা আটক

ফেনী জেলা যুবদলের সভাপতি জাকির হোসেন জসিম ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খন্দকারসহ চারজনকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

শনিবার রাত ১১টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকা থেকে তাদের আটক করার কথা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন র‍্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: মাহবুব আলম।

আটকের পর তাদের দু'জনকে ফেনী মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

তবে ওই নেতাদের কোনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে কি না এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি র‍্যাব।

ঢাকাসহ সারাদেশে মামলা এবং পুলিশের অভিযানে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করছে বিএনপি ।

এদিকে অবরোধ চলাকালে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেছেন, রোববার এবং সোমবারের অবরোধে নাশকতা রোধে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, অবরোধ শুরুর আগে ও চলার সময় চোরাগোপ্তা হামলাকারীদের ধরতে ঢাকার গণপরিবহনগুলোয় যাত্রী বেশে অবস্থান করবেন গোয়েন্দা সদস্যরা। সেইসাথে ঢাকাজুড়ে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোতেও সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে বলে তিনি জানান।

ঢাকায় প্রতিটি মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করা আছে, তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।

এদিকে, অবরোধের মধ্যেও ঢাকাসহ সারাদেশে সব রুট বাস-মিনিবাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।

এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অবরোধে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র বহনকারী গাড়ি, জরুরি সেবায় নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চলাচল, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধ বহনকারী যানবাহন অবরোধ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।

সূত্র : বিবিসি