নির্বাচনী হালচাল রাজশাহী-২: লড়াই হবে হাড্ডা-হাড্ডি

বিএনপির অভিজ্ঞতা আর জামায়াতের চ্যালেঞ্জ

মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৪১; আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৪৯

ডান থেকে: বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ডাঃ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও  এনসিপি প্রার্থী মোবাশ্বরে আলী।

রাজশাহীর ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন রাজশাহী-২ (সদর)। পুরো রাজশাহী সিটি করর্পোরেশন এলাকা নিয়ে গঠিত আসনটি বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। স্থানীয় রাজনীতিতে সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর ক্লিন ইমেজ ও দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাকে বাড়তি সুবিধা দিলেও দলের চাপা বিরোধিতা রয়েছে প্রকট ভাবে। অন্যদিকে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ও মহানগরীর নায়েবে আমির ডাঃ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। ভোটের মাঠে জনপ্রিয়তা, সংগঠনের শক্ত অবস্থান এবং সাম্প্রতিক জনমত বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে।

রাজশাহীর সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন রাজশাহী-২ (সদর)। সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় উপস্থিতির কারণে জাতীয় রাজনীতিতেও এই আসনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, আসনটিতে নগরভিত্তিক শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত ভোটারের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি। তরুণ ভোটার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এবং নারী ভোটার এখানে ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি এবার জুলাই বিপ্লবসহ নাগরিক ইস্যু, দলীয় কোন্দল এবং আওয়ামী লীগের  ভোট ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখবে। যার কারণে এবার ত্রয়োদশ নির্বাচন পূর্ববর্তী নির্বাচন এবং পরবর্তী  উল্লেখযোগ্য ঘটনা ভোটারদের ভিন্ন রাজনৈতিক ধারা ও ইস্যু ভিত্তিক মনোভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

রাজশাহী-২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৩ জন, যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১লাখ ৭১ হাজার ৪১৮ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৮১ হাজার ৩৫৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) ভোটার রয়েছেন ৮ জন। আর ভোট কেন্দ্র রয়েছে ১১৫টি।আসনটির সীমানা পুনগঠিত হয় ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে। আর তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, ১৯৯০ দশকে ও প্রথম থেকেই এই আসনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী শক্তপোক্ত প্রভাব রাখে। পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এখানে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও বিতর্কিত নির্বাচনে প্রকৃত হিসেব থেকে তারা ছিটকে পড়ে। এদিকে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কবির হোসেন ভোট পান শতকরা ৪৩ দশমিক ৪০ এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী আতাউর রহমান ভোট পান শতকরা ২১ দশমিক ৫০ ভাগ। পরবর্তী ২০০১ সালে এক লাখ ৭৬ হাজার ৪০৫ ভোট পান মিজানুর রহমান মিনু। এসময় মিনুর পক্ষে জামায়াত সমর্থনসহ সার্বিক নির্বাচনী প্রচারণা চালান।

নতুন এবং সচেতন ভোটাররা বলনে, মিজানুর রহমান মিনু একটানা তিন মেয়াদে ১৭ বছর মেয়র ছিলেন। ২০০১ সালে রাজশাহী-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। অথচ তার নির্বাচনকালীন যে ইশতেহার দিয়েছিলেন তার সিংহ ভাগ কাজ করেননি। আমরা এমন প্রার্থী চাই যারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। বিএনপির প্রার্থী সাবেক মেয়র ও এমপি মিজানুর রহমান মিনুর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কারণে সাধারণ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তবে এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা। দলের ভেতর মিনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে দুঃসময়ে রাজপথে না থাকা, মিডিয়া রাজনীতি এবং বিশেষ কওে জুলাই বিপ্লবে নিষ্কৃয়তা দলের ভেতর তার ব্যপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ নিয়ে দলের তার বিরুদ্ধে চাপা বিরোধীতা কাজ করছে। পাশাপাশি অভিযোগ আছে, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়ার পর রিজভী আহমেদ রাজশাহীতে মিনু ও তার অনুসারীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মিনু অনুসারী মহানগর বিএনপির বুলবুল-মিলন কমিটি কেন্দ্র থেকে আকস্মিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়। এরপর রিজভী অনুসারীদের নিয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এ কমিটিতে মিনু অনুসারীদের কাউকে রাখা হয়নি। গত চার বছর ধরে রিজভী অনুসারীরাই রাজশাহীতে বিএনপি পরিচালনা করছেন। আর মিনু অনুসারীরা পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় মহানগর বিএনপিতে বিভক্তি বিভাজন প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে মহানগর বিএনপির অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও চাপা বিরোধিতা তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একাধিক নেতা-কর্মীর মতে, এই কোন্দল নির্বাচনী মাঠে প্রভাব পড়লে তার প্রতিফলন ঘটতে পারে বিরুপ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ও রাজশাহী মহানগরীর নায়েবে আমির ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সংগঠনের শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো, নিয়মিত দাওয়াতি কার্যক্রম এবং নগরভিত্তিক ভোট ব্যাংকের ওপর ভর করে জামায়াত এই আসনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।

এদিকে রাজশাহী-২ আসনে জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি)র মনোনয়ন পেয়েছেন রাজশাহী মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মোবাশ্বরে আলী। তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবার পর সীমতি আকারে নির্বাচনী গণসংযোগ করেন। এছাড়া খেলাফত মজলিস, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থীদের নাম সামনে আসলেও তাদের কোন প্রচার-প্রচারণা নেই। 

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজশাহী-২ আসনে এবারের নির্বাচন ব্যক্তি জনপ্রিয়তার বিপরীতে সংগঠনের শক্তির এক বাস্তব পরীক্ষায় রূপ নিতে যাচ্ছে। দলীয় অভ্যন্তরীণ ঐক্য, ভোটার উপস্থিতি এবং শেষ মুহূর্তের রাজনৈতিক সমীকরণই নির্ধারণ করবে কার হাতে যাবে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটি। তবে আসনটিতে জয় পেতে মরিয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আর দীর্ঘ ১৭ বছর পর আসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বিএনপি।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top