বরিশালে ৬০ বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত
রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০৩; আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২১:২৮

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বাংলাদেশের স্থলভাগে এসে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এরপর এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড পার হয়ে ভারতের আসামের দিকে চলে গেছে। এতে দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে।
বরিশালসহ দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাতে বৃষ্টি থেমে যায়। মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সকাল থেকে দেখা মিলেছে রোদের। ঝড়ের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি ঝরেছে বরিশালে ৩২৪ মিলিমিটার। যা ১৯৬২ সালের পর একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড বলে জানিয়েছে বরিশাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, বিগত দিনে বরিশালে একদিনে এত বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। পুরনো তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তিনি বলেন, এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ২৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ডটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১০ নভেম্বর।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, শুরু থেকেই সিত্রাং এলোমেলো আচরণ করতে শুরু করে। বারবার পাল্টাতে থাকে গতিপথও। তাই এর গতিবিধি ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসতে পথে বৃষ্টি ঝড়িয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে। এসেছে দ্রুত, চলেও গেছে দ্রুত। সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। এরপর রাত নয়টার পর মূল অংশ আঘাত হানে। রাত একটার মধ্যেই উপকূল মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
বৃষ্টিপাতের কারণে বরিশাল নগরের সবগুলো রাস্তাঘাট এমনকি দোকান ও বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ে। একে বরিশাল নগর ও বিভিন্ন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরে। মঙ্গলবার বিকেলেও বেশ কিছু এলাকার পানি নামেনি।
নগরের ফকিরবাড়ি সড়কের সরকারি মহিলা কলেজ গেট সংলগ্ন ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান বলেন, বৃষ্টির পানি ঢুকে দোকানের অনেক মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে দুটি ফ্রিজ, কম্পিউটার এবং অন্যান্য মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকালে দোকানের পানি নামলেও সামনের সড়ক এখনও পানিতে ডুবে আছে।
নগরের অনেক এলাকার পানি নামলেও বেশকিছু এলাকার রাস্তাঘাট এখনো পানিতে নিমজ্জিত আছে। নগরের নবগ্রাম এলাকা, ফকিরবাড়ি, ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকা এখনো জলাবদ্ধ।
ঝড়রে কারণে বরিশাল নগরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ না হলেও ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে মঙ্গলবার সকালে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হলেও অনেক এলাকায় গাছ ভেঙে সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনও সরকরাহ সচল হয়নি।
পশ্চিমাঞ্চলীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির বরিশাল অঞ্চলের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেলের সহকারী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বিশ্বাস বলেন, প্রায় সব এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়েছে। তবে ঝালকাঠির নলছিটি, কাঁঠালিয়া এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ওপর অনেক গাছ ভেঙে পড়ে আছে। সে জন্য ওই এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা যায়নি। এ জন্য কাজ চলছে।
অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল শুরু
আবহাওয়ার উন্নতি হওয়ায় বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে নৌ চলাচল শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে রাতে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যথা নিয়মে যাত্রীবাহী দূরপাল্লার লঞ্চগুলোও ছেড়ে যাবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নৌ নিরপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক কবির হোসেন জানান, আবহাওয়ার উন্নতি হওয়ায় সকাল ৯টা থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে স্বাভাবিক নিয়মে লঞ্চ চলাচল করছে। আর রাতে ঢাকা-বরিশাল রুটে স্বাভাবিক নিয়মে লঞ্চ চলাচল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে সকাল থেকে বরিশালে আবহাওয়া স্বাভাবিক রয়েছে। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করছে।
বরিশাল জেলায় প্রস্তুত থাকা ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ২৫ হাজার মানুষ বাড়ি ফিরে গেছেন। সেইসঙ্গে গবাদিপশুকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বরিশালের সব নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাংয়ের’ প্রভাব কেটে গেলেও বরিশালের সকল নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে। মঙ্গলবার ভোলার তজুমুদ্দিন ও দৌলতখান উপজেলায় মেঘনা এবং সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার দেড় মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সিত্রাংয়ের প্রভাব, অমাবস্যার জোয়ার এবং অতিবৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে পানি কমতে শুরু করবে বলে তারা জানিয়েছেন। বিকেলে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোগাফি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলায় মেঘনা ও সুরমা নদীর পানি দুপুর ২টায় ১.৩৭ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে দৌলতখান উপজেলায় এই দুই নদীর পানি বিপৎসীমার ১.১৯ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভোলা খেয়াঘাট এলাকায় বিকেল ৪টায় তেতুলিয়া নদীর পানি ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিকেল ৪টায় কীর্তনখোলা নদীর পানি প্রবাহিত হয় বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বুড়িশ্বর ও পায়রা নদীর পানি প্রবাহিত হয় বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। বিষখালী নদীর বরগুনা পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হয় বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। একই নদীর পাথরঘাটা পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হয় বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। বলেশ্বর নদীর পিরোজপুর পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হয় বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। কঁচা নদীর উমেদপুর পয়েন্টে দুপুরে পানি প্রবাহিত হয় ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। আমতলীর বুড়িশ্বর ও পায়রা নদীর পানিও বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে বিস্তির্ণ নিম্নাঞ্চল, ফসলী জমি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব কিছু। এতে দুর্ভোগে পড়েছে জনসাধারণ। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন জানান, সিত্রাংয়ের প্রভাব, অমাবশ্যার জোয়ার এবং ভারী বর্ষণের কারণে নদীর পানি বেড়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানির চাপে সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদে ৩টি, বাকেরগঞ্জের নলুয়ায় ১টি এবং উজিরপুরের গুঠিয়ায় ২টি বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ৬শ’ মিটারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে জানমালের উল্লেখযোগ্য তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার। এ বিষয়ে সব উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত পরিসংখ্যান চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: