রূপপুর প্রকল্প: রাশিয়ার বন্ধুত্বের আড়ালে আধিপত্যের কৌশল

মো. রোকনুজ্জামান | প্রকাশিত: ২১ জুন ২০২৫ ২০:০০; আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০১:৩০

- ছবি - ইন্টারনেট

বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অনেকেই উন্নয়নের নিদর্শন বলে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু প্রকল্পটির আর্থিক কাঠামো, প্রযুক্তিগত নির্ভরতামূলক ব্যবস্থা ও এর পেছনে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—এই প্রকল্পটি একটি কৌশলগত ‘ট্রয়ান হর্স’।

একদিকে উন্নয়নের হাতছানি, অন্যদিকে নীরবে একটি দেশের ওপর প্রযুক্তি, ঋণ ও কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া—রাশিয়া ঠিক সেটাই করছে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি Rosatom রূপপুর প্রকল্পের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। তারা ডিজাইন, নির্মাণ, রিয়্যাক্টর সরবরাহ, ফুয়েল সরবরাহ, রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নিজের হাতে রেখেছে।

বাংলাদেশের নিজের হাতে কিছু নেই—এমনকি প্রশিক্ষিত মানবসম্পদও গড়ে ওঠেনি। এটি একটি পরিচিত রুশ কৌশল। সাবেক সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোতেও রাশিয়া ঠিক একইভাবে পারমাণবিক প্রকল্প দিয়ে আর্থিক ও রাজনৈতিক নির্ভরতা তৈরি করেছিল। আজকের দিনে বাংলাদেশ সেই একই ফাঁদে পা দিচ্ছে।

রূপপুর প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রায় ৯০% অর্থায়ন এসেছে রাশিয়ার কাছ থেকে। প্রায় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা বাংলাদেশের মাথায় চাপানো হয়েছে। সুদহার ১.৭৫%, শোধের সময়সীমা ২৮ বছর—দেখতে সুবিধাজনক মনে হলেও, প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় ও সময় অতিক্রম করলে এই খরচ আরও অনেকগুণ বেড়ে যাবে। রাশিয়া এখান থেকে সুদ গ্রহণ করছে, ফুয়েল বিক্রি করছে, নির্মাণ খরচ নিচ্ছে, আবার বর্জ্য ফেরত নিতে গিয়ে নতুন খরচও আদায় করবে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি "debt-service trap"—যেখানে আমরা কেবল অর্থ দিচ্ছি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছি না।

তথ্যসূত্র: Economic Relations Division, GoB (2021); Rosatom Annual Report (2020).

রূপপুরের রিয়্যাক্টর VVER-1200 কেবলমাত্র রাশিয়ার তৈরি ইউরেনিয়াম ফুয়েল গ্রহণ করতে পারে। অন্য কোনো বিকল্প সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

অর্থাৎ, পরবর্তী ৫০ বছরেও আমরা চাইলে রাশিয়ার বাইরে যেতে পারব না। এটিকে বলা যায় "fuel lock-in diplomacy"। এই নির্ভরতাই রাশিয়ার আসল কৌশল—বন্ধুত্বের নামে নিয়ন্ত্রণ।

রাশিয়া জানে, বাংলাদেশ একটি কৌশলগত অবস্থানে আছে—চীন ও ভারতের মাঝখানে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে। এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারলে রাশিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় তার জায়গা সুদৃঢ় করতে পারবে। রূপপুর প্রকল্প সেই ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। এটি শুধু একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়—এটি একটি কৌশলগত হাব, যেখান থেকে ভবিষ্যতের চুক্তি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পথ তৈরি হয়।

আমরা যদি ভবিষ্যতে রাশিয়ার কোনো বৈদেশিক নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিতে চাই, তখন এই প্রকল্প—তাদের একটি চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হয়ে উঠবে। এই বিপজ্জনক সম্ভাবনাকে কেউ প্রকাশ্যে আলোচনা করছে না।

এত বড় একটি প্রকল্প—যা দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে—সেই প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নীরব। ক্ষমতায় থাকা দল একে উন্নয়নের চিত্র হিসেবে দেখিয়েছে, আর বিরোধীরা এখনো এ নিয়ে তেমন কোনো জোরালো অবস্থান নেয়নি। এমনকি একটি 'ন্যাশনাল এনার্জি রিভিউ কমিশন' গঠনের দাবিও কেউ তোলে না। কেন? এটা কি বিদেশি কূটনৈতিক চাপ, নাকি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বাণিজ্যিক সুবিধা রক্ষার লোভ?

রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বে আপত্তি নেই। কিন্তু যখন সেই বন্ধুত্ব আমাদের প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও নীতিগত সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণের পথে ঠেলে দেয়, তখন সেটি আর বন্ধুত্ব থাকে না—তা হয়ে ওঠে আধিপত্য। রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার ভূমিকা এখন আর নিছক প্রযুক্তি সহযোগিতা নয়। এটি বাংলাদেশের উপর এক ধরনের শান্তিপূর্ণ, কিন্তু গভীর নব্য ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।

এই মুহূর্তে আমাদের প্রশ্ন তোলা উচিত—আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ একক কোনো দেশের হাতে তুলে দিচ্ছি?

লেখক : জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষক



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top