বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা
রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০২০ ২২:৫৫; আপডেট: ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৪
শিশুর জন্ম পরবর্তী অন্যতম চাওয়াই হলো শিক্ষা। শিক্ষা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই; সবাই শিক্ষা অর্জন করতে চায়, শিক্ষার মাধ্যমে জীবনটাকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে সাজাতে চায়। কারণ সুন্দর স্বপ্নের মাধ্যমে জীবনটাকে প্রাণবন্ত করতে এর কোন বিকল্প নেই। তাইতো পৃথিবীতে যত পেশার মানুষ-ই রয়েছে প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে শিক্ষার-ই নির্যাস। একটি মানসম্মত ও কাক্সিক্ষত মানের শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুন্দর সুশৃংঙ্খল শিক্ষা প্রশাসন, যার ব্যবস্থাপনা হবে গতিময়তায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেই সনাতন বলয় থেকে পরিপূর্ণভাবে বের হতে পারেনি আজও । স্বাধীনতা পরবর্তী এ দেশের উন্নয়ন কম হয়নি; উন্নয়নের মহাসড়কে ডিজিটালের পথে সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। তাত্ত্বিকভাবে ও পরিমাণগতভাবে শিক্ষাও পিছিয়ে নেই, উন্নয়নের সেই ধারা থেকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা অনেক পিছিয়ে, যতটুকু এগিয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েই গেছে। শিক্ষা মানুুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রতিটি উন্নয়নের পরতে পরতে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষা। দেশের জাতীয় উন্নয়নের সাথে জাতির আত্মিক উন্মেষের জন্য প্রয়োজন শিক্ষার। তাইতো মানসম্মত শিক্ষার জন্য একটি গতিশীল ও দক্ষ শিক্ষা প্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বর্তমানে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের চ্যাজেঞ্জ মোকাবিলার পর্যায়ে রয়েছি। এসডিজি-৪ বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ এর দিকে দৃষ্টিপাত করলে, সেখানে মানসম্মত শিক্ষা বা কোয়ালিটি এডুকেশন এর কথা বলা হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য অনেকগুলো টুলস্ রয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন একটি সুশৃংঙ্খল ও গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা আমাদের আজও দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে, শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, যুগান্তকারী শিক্ষানীতি পাস হয়েছে, অনেক শিক্ষানুরাগী তাঁদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থাপনা হতে বের হতে না পারায় মেধাবীদের মনোযোগ আজ অবধি শিক্ষা সংক্রান্ত পেশায় আকর্ষিত করা সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এঁর মতে- ”দেশের সবচেয়ে ব্যর্থ ছাত্রটিই সাধারণভাবে দাঁড়িয়েছে আজ এই জাতির ত্রাণকর্তা- শিক্ষক”। একই অবস্থা শিক্ষা প্রশাসনের ক্ষেত্রেও সমাজের যে মানুষটি সব ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে ব্যর্থ- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, দারোগা, দোকানদার - প্রায় কোন কিছুই হতে না পেরে জীবনের শেষ এবং একমাত্র অবলম্বন হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রের এই পেশাটিকেই (কর্মকর্তা) শেষ পর্যন্ত গর্বিত পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শ্রেণি ভর্তি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন করলে একজনও শিক্ষক বা শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মকর্তা হতে চায় না। যে পেশায় কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, মানসম্মত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই, নেই কোন সামান্যতম প্রমোশনের সুযোগ- সেদিকে আজকের আধুনিক বুদ্ধিমান মেধাবীরা কেন ছুটবে?
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিন্যাসটি তুলনা করলে অতি সহজে অনুমেয় শিক্ষা নিয়ে আমাদের আন্তরিকতার অভাব কতটুকু! প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে উপজেলা হতে প্রমোশন নিয়ে উপরের দপ্তরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অনেক মন্ত্রণালয়ে এক বা একাধিক বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তা রয়েছেন যাঁরা উপজেলাসহ উপরের দপ্তরগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রশাসন, কৃষি, প্রানিজ সম্পদ, মৎস, স্বাস্থ্য দপ্তরের বিষয় উল্লেখ করা যেতেই পারে; হয়ত আইসিটি ও পুলিশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা অতি দ্রুততম সময়েই দেখা যাবে। অনেক দপ্তর আছে, যাদের ক্যাডার কর্মকর্তা নেই কিন্তু প্রমোশনের ব্যবস্থা অতি চমৎকার; উদাহরণ হিসেবে সমাজসেবা, শিক্ষা (প্রাথমিক) উল্লেখ করা যেতেই পারে। শুধু নড়বড়ে অবস্থা আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষায়; এখানে না আছে কোন ক্যাডার কর্মকর্তা, আর না আছে কোন প্রমোশন ব্যবস্থা বরং প্রকল্প থেকে রাজস্বতে স্থানান্তরিত মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, পনের থেকে কুড়ি বছর ধরে প্রকল্পে কাজ করা সেসিপ প্রকল্পের জনবল, আর সরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের প্রেষণে নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুুঁড়িয়ে চলছে জাতির মানুষ গড়ার কারিগর খ্যাত এ দপ্তরগুলো। ফলশ্রুতিতে এই সকল কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কাজের মধ্যে প্রাণসত্বা খুঁজে পাওয়ার সুযোগ কম; সে আশা করাই বা কতটুকু সমীচীন? উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা দীর্ঘ দিন প্রকল্পে কাজ করে অবশেষে স্থায়ীকরণ হলেও একই পদে কাজ করছেন পঁচিশ থেকে সাতাশ বছর। সরকারী চাকুরীতে এসে একই চেয়ারে একই গ্রেডে সারা জীবন চাকুরীরত একজন মানুষের কাছ থেকে জাতি কি প্রত্যাশা করতে পারে? বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের জন্য। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষায় এ অবস্থা নেই, যে কারণে তারা এগিয়েছে অনেক দুর। বিসিএস ক্যাডার তাদেরও নেই, কিন্তু সুন্দর প্রমোশন পদ্ধতিই তাদেরকে উপহার দিয়েছে কাজের অতিরিক্ত মনোযোগ। সেখানে শিক্ষকদের মধ্য হতে সরাসরি প্রেষণে প্রশাসনিক পদে নিয়োগের কোন প্রকার সুযোগ নেই।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বের মডেল খ্যাত ফিনল্যান্ড এবং এশিয়ার মডেল খ্যাত সিংগাপুরসহ শিক্ষায় অগ্রগামী দেশগুলোতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাপদগুলোকে সবসময় সমান্তরাল রাখা হয়েছে। দুটি পেশা দুই মেরুর; একটি মহান পেশা যারা মানুষ গড়ার কারিগর, অন্যটি কর্মচারী বা কেরানী। একটির সাথে অন্যটির কোন তুলনাই চলে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব আমাদের দেশে মহান পেশার অতি সজ্জন মহান গুরুদের বাধ্য করা হয় কেরানীগিরিতে, যা অত্যন্ত পরিতাপের এবং অনভিপ্রেত। সুশিল দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এমন ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত। বিশ্বের কিছু কিছু দেশে অতি মেধাবী শিক্ষকদের মধ্য হতে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার মাধ্যমে দু-একটি লাভজনক পদকে অলঙ্কিত করা হয় কিন্তু প্রেষণের কোন সিস্টেম সেসব দেশে আদৌ নেই। তৃণমূল হতে পর্যায়ক্রমে যদি উপরের দিকে জনবল না টানা হয়, তাহলে মাঠ প্রশাসনের সাথে উর্দ্ধতন অফিসগুলোর এক ধরনের শূণ্যতা থেকেই যায়, যা কাজের গতি বা চেইন অব কমান্ড দুটোই বিনষ্ট করে। বিষয়টি ভেবে দেখার এখনই সময়। এ ক্ষেত্রে তরুণ মেধাবীদের যত বেশী কাজের সাথে সম্পৃক্ত করা যাবে ততই কাজের গতি বাড়বে এবং শৃংঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা অনেক। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস এবং জেলা শিক্ষা অফিস নামে যে অফিসগুলো রয়েছে সেগুলোর অফিস প্রধানগণের গ্রেড বা মর্যাদা অপেক্ষা সরকারী ও বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড অনেক ক্ষেত্রেই উপরে। এখানে এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। পুরো ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে চাইলে অর্গানোগ্রামের উপরের স্তর হতে নিচের স্তর পর্যন্ত ঢেলে সাজানো উচিত। তাছাড়া সরকারী মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে একই পদে থেকে সেবা দেন, যা অতি কষ্টের এবং অনাকাক্সিক্ষত। কাজের গতি ও ভালো সেবার জন্য প্রমোশনের ব্যবস্থা থাকা চাই; যদি এমন হতো তাঁরা সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব শুরুর পর প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক এবং তৃতীয় ধাপে প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র শিক্ষক হবেন এবং মেধা ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের লাভজনক পদদুটি পূরণ করা করা হবে।
বাংলাদেশের মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণকারী ডিজিটাল দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তা না থাকার বিষয়টি অতি উদ্বেগের। শিক্ষার ক্ষেত্রে উপজেলার পদগুলো যদি ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তা দিয়ে পূরণ করা হয় এবং তারাই পর্যায়ক্রমে উপজেলা হতে জেলা, জেলা হতে অঞ্চল এবং একইভাবে অধিদপ্তর পর্যন্ত যেতে পারেন তাহলে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতো শিক্ষাতেও সোনা ফলবে, এই প্রত্যাশা জাতি করতেই পারে। প্রয়োজনে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারকে দুটি অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে; এক. বিসিএস শিক্ষা (সাধারণ/ প্রফেশনাল), যারা সরকারী কলেজগুলোতে শিক্ষক (প্রভাষক) হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন। দুই. বিসিএস শিক্ষা (প্রশাসন), যারা শুরুতে উপজেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে অধিদপ্তর পর্যন্ত যাবেন। অন্যদিকে বিসিএস ননক্যাডারদের মধ্যে হতে সরকারী মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকের শূণ্য পদ পূরণ করা যেতে পারে। এমন একটি সিস্টেম শিক্ষার বিস্তার, শৃংঙ্খলা ও গতিশীলতার জন্য অতি পালনীয় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা যেতেই পারে।
শিক্ষানীতি-২০১০ এর অধ্যায়-৪ এর ১৫ নং ধারায় পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ শিরোনামে : "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনিকভাবে নিয়মিত ও কার্যকর পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে" এবং অধ্যায়-২৭ এর ০৫ নং "ধারায় প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক এর অফিস স্থাপন" সম্পর্কিত বিষয়ে বর্ণনা থাকলেও তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। মূলত আমাদের পরিদর্শন ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক; বর্তমান ডি আই এ অফিস নামে যে অফিসটি রয়েছে তারা শুধুমাত্র আর্থিক অডিট পরিচালনা করে থাকেন। একাডেমিক সুপারভিশন বা প্রতিষ্ঠানের নিবিড় মনিটরিং করার মতো সরাসরি স্থায়ী কোন কর্মকর্তা মাধ্যমিক খাতে নেই: অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এহেন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে প্রকল্পের জনবল দিয়ে করানো হয়, যারা বিভিন্ন সময় চাকুরীর নিশ্চয়তা জনিত সমস্যায় ভোগার কারণে পরিদর্শনের কাজটি আদৌ সুচারুরূপে হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
মাধ্যমিক শিক্ষা যেকোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর। কেননা মাধ্যমিক শিক্ষাশেষে শিক্ষার্থীরা সামর্থ্য অনুযায়ী হয় উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ধারায় যায়, নতুবা অর্জিত বৃত্তিমূলক শিক্ষার ভিত্তিতে বা আরো বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে জীবিকার্জনের পথ বেছে নেয়। মাধ্যমিক স্তরের মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে প্রাপ্ত মৌলিক জ্ঞান স¤প্রসারিত ও সুসংহত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ভিত শক্ত করতে সহায়তা করা উচিত। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মাধ্যমিক শিক্ষার অগ্রগতি ও এসডিজি-৪ এর কোয়ালিটি এডুকেশন সুনিশ্চিত করণের নিমিত্ত বর্ণিত বিষয়গুলোর দিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোকপাত করা যেতেই পারে।
লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত, একাডেমিক সুপার ভাইজার
ইমেইল: [email protected]
বিষয়: মাধ্যমিক শিক্ষা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: