রূপপুর প্রকল্প : স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও পরিবেশের সংকট

মো. রোকনুজ্জামান | প্রকাশিত: ২৩ জুন ২০২৫ ১৮:১৮; আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫ ২৩:১৯

- ছবি - ইন্টারনেট

একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে বাংলাদেশ তার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে বহুমুখী পথ অবলম্বন করছে।

এই পথে সবচেয়ে বিতর্কিত সংযোজন হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দেশের প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র হিসেবে রূপপুর প্রকল্প কেবল উন্নয়নের প্রতীক নয়, এটি বহুমাত্রিক ঝুঁকিও বহন করছে।

রূপপুর প্রকল্পের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ এবং ROSATOM-এর আধিপত্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি সরবরাহ এবং আধুনিকায়নে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বোঝাই নয়, বরং দেশের কৌশলগত সার্বভৌমত্বের ওপরও চাপ সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার এই আধিপত্যবাদী কৌশল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও তার প্রভাব বিস্তার করছে, যা বাংলাদেশকে বাধ্য করতে পারে তার স্বাধীন নীতি নির্ধারণে সীমাবদ্ধ হতে।

বাংলাদেশ একটি জলবায়ু সংবেদনশীল দেশ, যেখানে ঘনঘন বন্যা, নদী ভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়। পদ্মা নদীর তীরে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র এই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে পারমাণবিক প্ল্যান্টের নিরাপত্তা অতীব ঝুঁকিপূর্ণ।

পারমাণবিক বর্জ্য নিরাপদে সংরক্ষণ না হলে তা পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাবনাও প্রকল্পের জন্য বড় হুমকি।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো—বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ—এই সংবেদনশীল প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশে নীরব থাকার পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে। জাতীয় উন্নয়নবিরোধী তকমা এড়ানোর চেষ্টা, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থ এবং রাজনৈতিক লাভের আশায় তারা প্রকল্পের ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলার পথ এড়িয়ে যাচ্ছে। এই নীরবতা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে বিপজ্জনক।

আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফরাসী জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। ফ্রান্স ও ইইউর পরিবেশ রক্ষা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সম্মিলিত চেষ্টা চালাচ্ছে, যা রূপপুর প্রকল্পের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংলাপ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার ইউক্রেনের ওপর অবিচারপূর্ণ আক্রমণের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা ও সমবেদনা রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এমন কৌশলগত আধিপত্যবাদ স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের কারণ। রাশিয়ার এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া ও প্রতিবাদ করাই সময়ের দাবি।

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা এনে দিলেও, এর পরিবেশগত ঝুঁকি, রাশিয়ার আধিপত্যবাদী কৌশল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নীরবতা দেশের জন্য গভীর ভাবনার বিষয়।

নাগরিক সমাজ, পরিবেশ বিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং তরুণদের উচিত এই প্রকল্প নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও স্বচ্ছতা দাবি করা। দেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষায় এই সংকটময় সন্ধিক্ষণে সতর্কতা অবলম্বন করাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা।

লেখক : পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক, ডিভিএম - পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top