অনলাইন জুয়া
‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ ফাঁদে ২’শ কোটি টাকা পাচার
ডেস্ক নিউজ | প্রকাশিত: ১ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৩৩; আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২১:৩৭

অনলাইন গেমস ডেভেলপ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে আসছিল উল্কা গেমস লিমিটেড। তারা 'তিন পাত্তি গোল্ড' নামে একটি অনলাইন জুয়া দেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। নিয়মিত জুয়াড়ির সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। তাদের কাছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি করা হতো। এভাবে হাতিয়ে নেওয়া প্রায় ২০০ কোটি টাকা ভারতে পাচার করেছেন উল্কা গেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জামিলুর রশিদ। তিনি এর আগে দুটি গেম নির্মাণের জন্য সরকারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা অনুদানও পেয়েছিলেন।
অনলাইন জুয়া পরিচালনায় যুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর আজ সোমবার এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব। গ্রেপ্তার ছয়জন হলেন- জামিলুর রশিদ, সায়মন হোসেন, রিদোয়ান আহমেদ, রাকিবুল আলম, মুনতাকিম আহমেদ ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ। রোববার রাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকায় এ অভিযান চালায়। এ সময় জব্দ করা হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, সিপিইউ, সার্ভার স্টেশন, হার্ড ডিস্ক, স্ক্যানার, ডিভিডি ড্রাইভ, চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, নগদ টাকাসহ সরঞ্জাম।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উল্কা গেমস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জামিলুর রশিদের সঙ্গে ২০১৭ সালে প্রতিবেশী দেশের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটির অনলাইন জুয়ার অ্যাপ 'তিন পাত্তি গোল্ড'-এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এটিকে আরও ছড়িয়ে দিতে এবং দেশে বৈধতা দেওয়ার কৌশল খোঁজেন। এক পর্যায়ে আইনজীবীর পরামর্শে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে তিনি সংশ্নিষ্ট দপ্তর থেকে 'উল্কা গেমস প্রাইভেট লিমিটেড' নামে একটি গেম ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেন। ওই বছর মুনফ্রগের শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার উল্কা গেমসকে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রদানের চুক্তি হয়। দেশে গেম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া/ক্যাসিনোর অনুমোদনের সুযোগ না থাকায় উল্কা গেমস ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্নিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবেই 'তিন পাত্তি গোল্ড' যাত্রা শুরু করে এবং সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। উল্কা গেমসের যাত্রা গেম ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও তারা মূলত বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে আসছিল।
র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, 'তিন পাত্তি গোল্ড' একটি অ্যাপ, যা মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করে খেলা যায়। এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে রয়েছে। অ্যাপে 'তিন পাত্তি গোল্ড' ছাড়াও রাখি, আন্দর বাহার ও পোকার নামে অনলাইন জুয়ার গেম রয়েছে। গেমসে রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেওয়া হয়। পরে খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস সংগ্রহ করতে হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে চিপস বিক্রির অর্থ লেনদেন হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬-৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে 'তিন পাত্তি গোল্ড'-এর চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর/এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো। এসব ডিস্ট্রিবিউটরের আবার সাব-ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে। এ ছাড়াও প্রাইভেট টেবিল অপশনের মাধ্যমে অন্য প্লেয়ারের কাছ থেকেও চিপস কেনা যায়।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, ভার্চুয়াল চিপস অর্থের বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চিপস বিক্রির টাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে উল্কা গেমসের চারটি অ্যাকাউন্টে ৮০ কোটির বেশি টাকা রয়েছে। গত দুই বছর তারা মুনফ্রগ ল্যাবকে ব্যাংকের মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা দিয়েছে। উল্কা গেমসের ৩৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনসহ অফিস পরিচালনায় প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জামিলুর রশিদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর বিদেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসেন। অনেক আগে থেকেই তিনি মোবাইল গেমের প্রতি আসক্ত। ২০১৫ সালে নিজেই মোবাইল গেম তৈরির কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে হিরোজ অব ৭১ ও মুক্তি ক্যাম্প নামে দুটি গেম নির্মাণের জন্য তিনি সরকারের অনুদান পান। পরে ওই বছরই তিনি মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে যুক্ত হন। সর্বশেষ তিনি মুনফ্রগ থেকে মাসিক প্রায় ৪ লাখ টাকা বেতন পেতেন। এ ছাড়াও বার্ষিক আয়ের ৯০-১০০ শতাংশ বোনাস পেতেন। তাঁর বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা, দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে।
সূত্র: সমকাল।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: