গুরুত্ব হারিয়েছেন নয়াপল্টনে

মাইনাসের সারিতে খালেদা, নেতৃত্বের প্রায় সমাপ্তি!

আবদুর রহিম | প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৩৩; আপডেট: ২১ মে ২০২৪ ০৩:৪৩

ফাইল ছবি

রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায় সমাপ্তি! সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। নেতৃত্ব নিয়ে হয়তো আর জনগণের মাঝে আসবেন না। গুলশান থেকে নয়াপল্টনে গুরুত্ব হারিয়েছে দলটির প্রধান নেত্রীর নির্দেশনা। অভাব জাতীয়তাবাদের চরিত্রেরও। সংস্কারবাদী-বাম আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি!

খালেদা জিয়ার প্রভাব সময়ে ক্ষমতা চাচ্ছে না দলটির একটি অংশ। ভবিষ্যৎ ক্ষমতার চিন্তায় খালেদা জিয়াকে চির মাইনাসের প্রক্রিয়া চলছে। পন্থি দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে! ঢাকা-৫ আসনে ভোটের মাঠে মির্জা ফখরুল ও ইশরাক হোসেন না নামায় এবং ১৮ আসনের প্রার্থীর বিরুদ্ধে আন্দোলন। ভাঙন চলছে দলে।

অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি এখন জাতীয়তাবাদী চরিত্রে পরিচালিত হচ্ছে না। জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়ার নীতি আদর্শে বৃহৎ এ দলের রাজনেতৃত্ব চলছে না। বিএনপির ভেতর থেকে যেসব সংস্কারবাদীরা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার নেতৃত্ব দিয়েছেন, হঠাৎ করে বাম রাজনীতি থেকে যারা এ দলে এসে বড় নেতা হয়ে গেছেন, তাদের আদর্শেই বিএনপি চলছে। আন্দোলনে চুপ থাকা। সরকারের দয়ার সিদ্ধান্তে বের হওয়ার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ইতি ঘটেছে সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রীর।

দলের ভেতর থেকে বড় একটি অংশের দাবি, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়া, মাত্র ছয়জন সংসদ সদস্যকে সংসদে পাঠিয়ে এই সরকারকে বৈধতা দেয়া, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে চুপ থাকা, রাজনৈতিক বড় ইস্যুতে নীরবতা, দলের সকল অঙ্গ সংগঠনে কমিটি না দিয়ে দলকে নেতৃত্বশূন্য রাখা সব কিছুই বিপজ্জনক পরিকল্পনায় চলছে।

বিশেষ করে দলটির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন সরকারের অধিনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হবে না এমনটা দাবি করেও বিএনপি কেন নির্বাচনে যাচ্ছে এই রহস্য তারাও বুঝছে না।

তবে নির্ভরযোগ্য একটি অংশের ভাষ্য, কোনো ইস্যুতে নেতাকর্মীদের যদি একবার আন্দোলন জোস চাঙ্গাভাব তৈরি হয়ে যায় তাহলে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মাঝপথ থেকে অন্য কেউ ফায়দা হাসিল করে নিতে পারে। এ অবিশ্বাসই বিএনপিকে বড়ভাবে বাধা দিচ্ছে।

দলটির বিশ্বস্ত একটির সূত্রের দাবি পাশের একটি দেশ, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিজনেস পলিসির জন্য বিএনপিতে বাম রাজনীতির আদর্শ তৈরি করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই সূত্রটির মতে, বিএনপি আরও দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকবে তবে আবার দীর্ঘ সময় বিএনপি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে পারে। ভবিষ্যৎ সেই ছকের আলোকেই কয়েকজন নেতাকে হাতে রেখে আশ্বাসের বাণী দিয়ে বিএনপি থেকে জাতীয়তাবাদী চরিত্র মাস্টার প্ল্যানে দুরের প্রক্রিয়া চলছে।

আন্তর্জাতিক ওই মহলটি খালেদা জিয়া আটক থাকাকালীন কোনোভাবেই চায়নি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম হোক। অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধে কোনো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হোক। সবসময় মহলটি খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিএনপিকে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল, সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছিল।

কয়েক মাস পরপর খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছিল সরকারের অঙ্কিত ছকে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী করোনা ইস্যুতে বের হওয়ায় খালেদা জিয়ার অর্জিত সম্মান নষ্ট হয়ে হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ রাজনীতি আজীবনের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে এখন দলটির নেতাকর্মীরা দাবি করছে, বিএনপিতে এখন মির্জা আব্বাস-সাদেক হোসেন খোকাদের দৃশ্যত রাজনৈতিক ভূমিকা নেই! রাজনীতিতে আর বিচক্ষণতা নেই মওদুদ আহমদের। আমি খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়দের কূটনৈতিক সফলতাও নেই।

অভিযোগ রয়েছে, দলের এই অবস্থান ও সবাইকে পঙ্গু করার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছেন একজন মির্জা ফখরুলের! কারণ ফখরুল মহাসচিব হওয়ার পর থেকে বিএনপি আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, জয়নুল আবেদীন, হাবিব-উন-নবী সোহেলরা দীর্ঘ সময় মাঠের কার্যত নেতৃত্ব থেকে দূরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, বরকত উল্লাহ বুলু, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বড় একটি অংশ নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না।

শুরু থেকেই তাদের দাবি ছিলো খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে এবার শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে এই সরকারকে বৈধতা দেয়া। কিন্তু নির্বাচনে যাওয়ার ব্যপারে অনড় ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ড. কামালদের বিএনপির সংসারে এনে করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

আর এর পেছনে মূল ভূমিকা ছিলো বিএনপি মহাসচিবের। নির্বাচন ও খালেদার মুক্তি ইস্যু নিয়ে যখন সরকারকে দমিয়ে দেয়ার সুযোগ এসেছিল, ঠিক তখন শুরু হয় ড. কামালকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির সমাবেশে সুলতান মনসুর এক হাতে ধানের শীষ আর গায়ে মুজিব কোট পরে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছেন, ড. কামাল বঙ্গবন্ধুর গুণগান করছেন, কাদের সিদ্দিকী নির্দেশ দেন যাতে নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা মহাসচিবকে মানে! আর যদি না মানে তাহলে বিএনপির কপালে আরও দুর্গতি আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে যখন একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা চলছে অথচ বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারছেন না, দেশব্যাপী প্রার্থীদের ওপর হামলা চলছে, রক্তাক্ত হচ্ছেন গয়েশ্বররা, তখন মহাসচিব বারবার ছুটে যাচ্ছেন কারাগারে! বন্দি খালেদা জিয়াকে বোঝাতে।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে গেলে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পাবে, সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হয়ে যাবে, জনগণ ভোটকেন্দ্রে ছুটে যাবে। ভোটবিপ্লব হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সবশেষ অন্যদের পরামর্শ টেকেনি দিনশেষে ফখরুল খালেদা জিয়াকে ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য।

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির কোমর ভাঙার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ফখরুলের আঁতাত রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। নরম ফখরুলের কাছ থেকে এখনো ক্ষমতাসীন দল সুবিধা নিচ্ছে। দলের সব কঠিন ইস্যুগুলোও তিনি সহজভাবে গ্রহণ করছেন! বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েও তিনি এর আগে পজেটিভ ছিলেন! ড. কামালের ঐক্যতেও তিনি পজেটিভ ছিলেন!

একাদশ সংসদ নির্বাচনে সকাল ১০টার আগেই অনেক প্রার্থী রাতে সিল মারার অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়, তখনো মহাসচিব পজেটিভ ভাষায় গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখনো জয়ের ব্যাপারে বিএনপি আশাবাদী। সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্য, ষাটের দশকে যে নেতা ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন।

১৯৯১ সালের পর দুইবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে নির্বাচনে হেরে যান অথচ এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে একমাত্র ওই নেতা বড় ব্যবধানে জিতে যান। যেখানে বিএনপির অন্য সাবেক জনপ্রিয় মন্ত্রী-এমপিরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে ভরাডুবির শিকার হন।

সেই নেতাই ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বলেছিলেন, ‘আপনার বিবেচনায় যাকে ইচ্ছা, তাকেই ভোট দিন। আমি সেই সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করি। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যখন দলের পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, নৌকা প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্বকারী নেতা ভোট চেয়েছেন সুশীলদের ন্যায়, বামপন্থিদের ন্যায়, বুদ্ধিজীবী কবি-সাহিত্যেকদের ন্যায়!

সেই মির্জা ফখরুল নির্বাচনে কেন ধানের শীস প্রতীকে ভোট চাননি, বন্দি খালেদা জিয়ার পক্ষে ভোট চাননি, জিয়াউর রহমানের পক্ষে ভোট চাননি— এমন সব জবাব দলের ভেতর এখনো অজানা। আসলে বিএনপিতে কী চেয়েছেন ফখরুলরা। জানতে চাচ্ছে জিয়া পরিবার?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়া সদরের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে যিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসেন তিনি হলেন গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। যিনি মনোনয়ন পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সংস্কারপন্থি বলে পরিচিত ছিলেন বিএনপিতে। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যিনি প্রয়াত বিএনপি মহাসচিব ও দলটির সংস্কারপন্থিদের প্রধান সংগঠক মান্নান ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ছিলেন। জিএম সিরাজই প্রথম প্রকাশ্যে বিএনপিতে নেতা পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মুখ খুলেছিলেন।

যিনি খোদ বেগম জিয়াকে নাড়িয়ে দিতে চাইলেন এক-এগারোর সময়ে তিনি হলেন ’৯১ থেকে প্রতিটি নির্বাচনে দলের চেয়ারপারসনের আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী! অবশেষে সেই সিরাজও এখন বিএনপির বুকে! কৌশলী ফখরুল সংস্কারবাদী নেতাদের বিএনপিতে প্রবেশ করাতে তিনি শপথ নেননি। শুধু সিরাজ নয়, বিএনপিতে এখন এমন ডজন ডজন নেতা মূল আদর্শের বাইরে থেকে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, লন্ডন-আমেরিকা থেকে আদেশে দল চালানো যাবে না। স্থানীয় আদেশে দল চালাতে দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের পরপর তারা যদি নীরব না থেকে আন্দোলনটা গড়ে তুলতে পারতো, তাহলে আজকের নির্বাচনগুলোও সুষ্ঠু হতে পারতো।

তারা এ নিয়ে কোনো শঙ্কা প্রকাশ করা লাগতো না। মৌলিকভাবে তারা তো আন্দোলন করছে না। নেতাকর্মীদের কাউন্সেলিং করছে না। এরপর সরকার বিএনপি থেকে আরও বেশি সুবিধা পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিএনপির চলমান নেতৃত্ব অনুগত অনুশীলনযোগ্য নয় মন্তব্য করে

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও কৃষক দ?লের আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘বর্তমা?নে কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। সবাই কথা বলতে চায়। কেউ কাউকে নেতা মানতে চায় না। সবাই এখন নেতা হতে চায়।’

 সৌজন্য : দৈনিক আমার সংবাদ: প্রকাশ:০৭-১১-২০২০



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top