দেনা বাড়ছে, জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ৩০ জানুয়ারী ২০২৪ ১০:২৯; আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৮

ছবি: সংগৃহীত

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেশে দিন দিন দেনার পরিমাণ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আসছে গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রয়োজনীয় বাড়তি গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।

সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)।

জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এর বাইরে আরও কিছু খাতে বকেয়া রয়েছে। সবমিলিয়ে মোট দেনার পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

একদিকে সরকার টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না, অন্যদিকে ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে সংকট এখন বিরাজ করছে, সেটা একদিনে তৈরি হয়নি। হঠাৎ করে কিংবা দৈব-দুর্বিপাকেও তা জাতির ওপর চেপে বসেনি। দিনে দিনে এই সংকটটা পুঞ্জীভূত করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো না করার জন্য আমরা গত দেড় দশক ধরে বলে আসছি। যে আশঙ্কার কথা বলে আসছি, তারই নানামুখী অভিঘাতের শিকার হচ্ছি এখন। এতেও বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। সরকার এখন তেলের রিফাইনারি করতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে। এটা একটা ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই ব্যাপারটা এখন আপনি-আমি যেভাবে বুঝতে পারছি, সেভাবে সরকারকেও বুঝতে হবে যে, আমরা সত্যিকার অর্থেই সংকটে পড়েছি। যেসব ভুল ও অদূরদর্শিতার কারণে এই সংকট ডেকে এনেছি, সেটা সরকারকে স্বীকার করতে হবে এবং সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে। সেই চেষ্টায় জনগণের সম্পৃক্ততা আনতে হবে। অব্যবস্থা, দুরবস্থা কিংবা সংকট যাই বলি না কেন, সরকারকেই সেটা মোকাবিলা করতে হবে। শামসুল আলম আরও বলেন, এই বেসিক ব্যাপারটা যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারের ভেতর না দেখা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমস্যাই সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

শামসুল আলম বলেন, সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎসহ এলপিজি, এলএনজি ও কয়লার মতো জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীরা এটা কত দামে উৎপাদন করছেন এবং সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন সেগমেন্টে যে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করা দরকার। এই বিচারটা হচ্ছে না। উপরন্তু বিইআরসি আইন পরিবর্তন করে সেখানে গণশুনানি রহিত করে এখন প্রতি মাসে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এটাও প্রচণ্ড রকমের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

এই খাতের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার সমালোচনাও করেন এই অধ্যাপক। বলেন, সরকারি মালিকানাধীন যেসব কোম্পানি আছে সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দেখা যায়, সেসব কোম্পানির মালিকানা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের। এতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। মালিক হিসেবে তারা লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী। আবার সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে তারা জ্বালানি বিভাগের সচিব, অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে। রেগুলেটর তো কখনো মালিক হতে পারে না। মালিক কখনো রেগুলেটর হতে পারে না। এই জায়গাটা ভাঙতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিকে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার জায়গা থেকে সরে এসে সুলভ মূল্যে সেবা দিতে হবে। তাই যে কারণে এই সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে, সেই কারণগুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। এটা স্বল্পমেয়াদে সম্ভব না। অর্থাৎ টাকা ছাপিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যে দেনাটা তৈরি হয়েছে তার দায় জনগণ নিতে পারে না। কারণ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে সরকারের দেনা বেড়েছে বিষয়টা এ রকম না। কিন্তু সরকার থেকে বিষয়টা এভাবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা চলছে যে, আমাদের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে। সুতরাং দামও বাড়াতে হবে।

জ্বালানি খাতে উৎপাদন খরচ যেটা বেড়েছে সেটা এলএনজি আমদানি করার কারণে এবং টোটালি আমদানিনির্ভর ও ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলো নেয়ার কারণে। বিষয়টা অনিবার্যও ছিল না। এমন যদি হতো যে, ঋণ না নিয়ে, এলএনজি না এনে আর কোনো উপায় ছিল না তাহলে একটা যুক্তি ছিল।

এদিকে আগামী মার্চে গরমের মৌসুম শুরু হচ্ছে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। টাকার অভাব ও ডলার সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। জ্বালানির অভাবেই গত বছর গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয় বলে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, যা নিয়ে নাখোশ অর্থ বিভাগ।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিদেশি কোম্পানির দেনা পরিশোধে ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতাকে দায়ী করে থাকেন। তারা মনে করেন, দেশে গ্যাস উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকার আমদানির পথ বেছে নিয়েছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এখন।

বিপিসি সূত্র বলছে, প্রতি মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় তাদের। কিন্তু ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলো নিয়মিত গড়িমসি করে। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে। বিপিসি’র হিসাবে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির বকেয়া বিল জমেছে ২৭ কোটি ডলার। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাঝে-মধ্যে দুই কোটি ডলার করে ছাড় করা হয়। তবে তা দিয়ে বকেয়া পুরোটা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানিগুলো বকেয়া না পেলে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করার বিষয়ে সতর্ক করছে।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top