‘বাণান’ ভুল, প্যাঁচে রবি ঠাকুর!

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ৮ মে ২০২২ ২০:৩২; আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ২০:৪৭

ছবি: প্রতীকী

তিনি কবিগুরু, বিশ্ববরেণ্য হতে পারেন, কিন্তু তিনিও ‘বাণান’ ভুল করেন— এই অভিযোগ জানিয়ে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের ছাত্র দেবপ্রসাদ ঘোষ! বাংলা ভাষা ও ‘বাণান’ নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতানি ছিল নজিরবিহীন।

রবি ঠাকুরকেও বেমক্কা প্যাঁচে পড়তে হয়েছিল বইকি! বানান যে ভুল ‘বাণান’, তার ভূরিভূরি উদাহরণ আলমোড়ায় চিঠিতে পাঠিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত দেবপ্রসাদ ঘোষ। এমন সাহস এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধহয় একটু দুর্লভ।

রবি ঠাকুর ও অন্যান্য পণ্ডিতরা কি কখনও ভুল করতে পারেন, এমন অজুহাতে খড়ের কুটোর মতো চেপে ধরেছিলেন ‘বাণান’ কমিটির হোতাদের। বোধহয় কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েই বলে ফেলেছিলেন, অনেকে অনেক কথাই বলবেন কিন্তু তার জন্য তুমি রবে নিরুত্তর। অথচ ফরাসি ভাষার ‘সিল ভু প্লে’-কে তিনি ভুল করে ‘সি ভু প্লে’ লিখেছিলেন। আর যাঁরা সত্যিকারের বই, ধর্ম এবং কর্ম ভাবতেন, তাঁরা অত ভাবেন না লেখক ব্যক্তিটি কে! আর তাই সরাসরি কলকাতা থেকে আলমোড়া কাগজের মোড়কে পুরে রাখা বার্তার পৌঁছাতে দেরি হয়নি। সেই পত্রালোচনা দেখিয়ে দিয়েছে, রবি ঠাকুর হোক কিংবা শেক্সপিয়ার— ‘বাণান’ ভুল এঁদের মতো মানুষ করলে তার দায় থেকেই যায়, কারণ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁদের ব্যবহার্য বানানই শেষ কথা।

বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের খ্যাতিমান ছাত্র দেবপ্রসাদ ঘোষ ছিলেন অঙ্কে পণ্ডিত, কিন্তু শুধু অঙ্কেই তিনি আটকে ছিলেন না। আক্রমণাত্মক রক্ষণশীল চরিত্রের এই মানুষটি বাংলা ভাষাকে আন্তরিক ভাবে ভালোবাসতেন এবং তাঁর মর্যাদা রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। একদা রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বানান সম্পর্কে কিছু নববিধান আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। ‘বাণান’ কমিটিতে ছিলেন রাজশেখর বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শহীদুল্লার মতো ভাষাতাত্ত্বিকগণ। কিন্তু নাম অথবা পদ দেখে কথা বলতেন না পণ্ডিত দেবপ্রসাদবাবু। কমিটিতে বৌ শব্দে ঔ কার বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সুনীতিবাবু বলেন যে বউ শব্দটি দেখতে ভালো। দেবপ্রসাদবাবু দেখিয়ে দেন যে ‘বৌ’ শব্দটিই ঠিক উচ্চারণ, কারণ এটি diphthongal এবং monosyllabic। ‘বৌ’ এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে, ব-উ ডিসিলেবিক। তাঁর রক্ষণশীলতা বাংলা ভাষার আদি রূপ রক্ষার্থে সদাজাগ্রত।

আমরা তাঁর পত্রে দেখেছি, তিনি বলেছেন যে এই ভাষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই, এই ভাষার রূপ সুপ্রতিষ্ঠিত। তা যেন ভাঙা না হয়৷ নির্দ্বিধায় মহাকবিকে তিনি জানান, তাঁর বড় ছেলেটি থার্ড ক্লাসে পড়ে এবং তাঁর জন্য তিনি রবিবাবুর ‘ছুটির পড়া’ বইটি কিনেছিলেন। সেখানে ‘সূর্যকিরণের ঢেউ’ প্রবন্ধে Wave theory of light-এর আবিষ্কর্তা হিগেন্সের নাম দেওয়া আছে। তিনি কবিকে জানান যে ব্যক্তির নাম হয়গেন্স (Huygens) এবং তাঁর নিবাস ডেনমার্ক নয় হল্যান্ড। তিনি এ-ও জানান, বইটি ২৮ বছর আগে মুদ্রিত এবং বহুবার নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে, তবু এই ভুলটি শুধরানো হয়নি। তা ছাড়া একবার শিশুপাঠ্য মাসিক পত্রিকায় দেবপ্রসাদ লক্ষ করেন যে ফরাসি S'il vous plait-কে বিশ্বকবি লিখেছেন সি ভূ প্লে। ‘l’ অক্ষরটি যে এখানে নীরব নয়, তা দেখিয়ে দেন তিনি। এই মানুষটি এও বোধ করেছিলেন যে রবি ঠাকুর ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন, তবুও ভুলকে ভুল বলতে তিনি পিছু হঠতেন না। তাই বারংবার ক্ষমা চেয়েছেন এবং কারণ হিসেবে বলেছেন যে, রবি ঠাকুরের ন্যায় ব্যক্তিত্ব যদি ভুল করেন তা সাধারণের জন্য নজির হয়ে যায়।
তাঁর ‘বাণান’ সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান বিশ্বকবিকেও থমকে দেয়। তাই শেষ চিঠিতে তিনি জানান, স্বাস্থ্য এবং সময়ের অভাববশত তাঁর পক্ষে এ তর্ক চালানো অসম্ভব। যদিও এখানেই দেবপ্রসাদ থেমে থাকেননি। তিনি মাসিক ‘বসুমতী’তে এই পত্রালোচনা ছাপান। যদিও হতাশ ভাবে এ-ও বলেন যে এ কাজ অনাবশ্যক। নিজের উদ্যোগকে এমন অনাবশ্যক বলার পিছনে তাঁর মন খারাপ একটি প্রধান কারণ। তিনি বঙ্গীয় গভর্নমেন্টের ঘোষণায় জানতে পেরেছিলেন যে, প্রচলিত ‘বাণান’ চলবে পাঠ্যপুস্তকে।

এ হেন নীতিবাগীশ একজন সৎ ব্যক্তিত্ব কিন্তু বাংলা ভাষায় এতটুকু অনাচার সহ্য করতে পারতেন না। গোঁড়া পুরোহিতের মতোই তিনি ‘বাণান’ কমিটিতে পেশ করতেন আদি অকৃত্রিম নিয়ম। উদাহরণস্বরূপ মনে পড়ল ‘চলন্তিকা’ নামক অভিধান সম্পাদনা করতেন শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসু। বিসর্গ অব্যয় শব্দে থাকা উচিত যেমন — ক্রমশঃ, বস্তুতঃ, পুনঃ পুনঃ ইত্যাদি—এমনই ছিল দেবপ্রসাদবাবুর মত। রাজশেখর বসু জানান যে তেমন নিয়ম প্রাতঃ কথাটির ক্ষেত্রে হবে না, কারণ তার মানে হল সকাল, অতএব সেটি অব্যয় নয়। দেবপ্রসাদ তাঁকে বোঝান, শুধু মানে দিয়ে অব্যয় হয় না সংস্কৃতে, প্রাতঃ, সায়ং ইত্যাদি অব্যয়। Art for Art’s sake-এর মতো সংস্কার করার জন্য করা পদ্ধতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। যেখানে কোনও গোলমাল নেই, সেখানে হঠাৎ নতুন কোনও সার্জারি করা তাঁর অপছন্দ ছিল। তাই এ হেন বদলের ক্ষেত্রে তিনি বলতেন—
The University can do everything but make a right form wrong and a wrong form right।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top