নজরদারিতে শীর্ষ ৬০ আমদানিকারক
রাজ টাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:৫৮; আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫৮

দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও পেঁয়াজের দাম ভোক্তা সহনীয় করা যাচ্ছে না। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগেও আসছে না ইতিবাচক ফল। গত ৩ দিন (রোববার-মঙ্গলবার) রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যটির দাম উচ্চমূল্য স্থিতিশীল থাকলে বুধবার ফের কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
বাজার অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে বেশ কয়েকজন আমদানিকারকের কারসাজি রয়েছে- এমন তথ্য পেয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এরপরই দেশের শীর্ষ ৬০ পেঁয়াজ আমদানিকারককে নজরদারিতে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ ৬০ আমদানিকারকসহ অন্য ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানির এলসির তথ্য চেয়েছে মন্ত্রণালয়। তাদের অনিয়মের বিষয়টি নিশ্চিত হলেই মন্ত্রণালয় দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওইসব আমদানিকারক সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই বাজার বেসামাল হয়েছে। গত ৩ মাসে দেশের স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় পৌনে দুই লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যা আমদানিকারকদের কাছেই মজুদ ছিল। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের পর সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কেটেছে এ সিন্ডিকেট।
এদিকে বুধবার রাজধানীর সর্ববৃহৎ পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা। যা এক দিন আগে বিক্রি হয় ৬৫-৭০ টাকা। আর এ দাম গত ৩ দিন (রোববার-মঙ্গলবার) বহাল ছিল। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি। যা এক দিন আগে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ টাকায়। যা এক দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জুন থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬টি বন্দর দিয়ে ৬০ জন আমদানিকারক ১ লাখ ৭৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। এর মধ্যে ভোমরা স্থলবন্দরের ২১ জন আমদানিকারক, সোনামসজিদ স্থলবন্দরের ২০ জন, হিলি স্থলবন্দরের ১২ জন, বেনাপোল স্থলবন্দরের ৪ জন, চট্টগ্রাম বন্দরের ২ জন ও টেকনাফ স্থলবন্দরের একজন আমদানিকারক এসব পেঁয়াজ দেশে এনেছেন। যা দেশে ঢোকার পর শুল্ক পরিশোধ করে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়েছে সাড়ে ২৭ টাকা। তবে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের পর ১৪, ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর এ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা।
জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যুগান্তরকে বলেন, সব ব্যবসায়ী লাভ খোঁজেন। সিন্ডিকেট করে লাভ করে। সুযোগ পেলে নিজে নিজেই দাম বাড়িয়ে দেয়। ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পরও আমদানিকারকদের কাছে আগের আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল। তারা জানে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসতে দেরি হবে। তাই সুযোগ বুঝে তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে তারা। তিনি জানান, আমরা অসাধুদের বিরুদ্ধে নজর রাখছি। দাম নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পেঁয়াজ আমদানিকারকদের একটি গ্রুপ সব সময় ওতপেতে থাকে কখন ভারত রফতানি বন্ধ করে দেয়। অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা অজুহাতের অপেক্ষায় থাকে ওই চক্রটি। সৃষ্টি করে কৃত্রিম সংকট। রাতারাতি অস্বাভাবিক গতিতে বাড়িয়ে দেয় পেঁয়াজের দাম। গত বছর পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ওই সময় পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজির দায়ে চট্টগ্রাম ও টেকনাফকেন্দ্রিক ১৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এবারও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে। যদিও দেশটি রফতানি বন্ধের ১৫ দিন আগে (৩১ আগস্ট) থেকেই পেঁয়াজের দামে ঊর্ধ্বগতি ছিল, যা এখনও অব্যাহত। এতে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় উঠে। সর্বোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে বাড়তি মুনাফা তুলে নিয়েছে অসাধুরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি টিমের সদস্য ও মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব আছাদুজ্জামান বলেন, আমদানি ও দেশি মিলে দেশে ভালোভাবে চলার মতো পেঁয়াজ আছে। কোনোভাবে দাম বাড়ার কথা নয়। এখানেই বোঝা যায়, দাম বাড়ানোর পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। কালোবাজারি বলি বা ফটকাবাজি বলি, এ কারসাজি করছেন মূলত আমদানিকারকরা। আর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি করেছে, এমন ৬০ জনের ওপর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারসাজির পেছনে তাদর হাত থাকলে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে। তাই পণ্যটির কোনো ধরনের সংকট নেই। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য আবু রায়হান আল বেরুনী বলেন, বর্তমানে দেশে সাড়ে ৫ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ মজুদ আছে। এ পেঁয়াজ দিয়ে আরও ৩ মাস বা সাড়ে ৩ মাস চলবে। এছাড়া আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ আছে, তা আগের চেয়ে কম দরে এলসি করা। সে ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
এদিকে পেঁয়াজের দাম সহনীয় করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে টিসিবির মাধ্যমে অনলাইন ও ট্রাক সেলে ভর্তুকি মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিশেষ সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত বাকিতে এলসি খুলে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুযোগ বলবৎ থাকবে। এর আগে পেঁয়াজ আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর পেঁয়াজ আমদানির এলসি মার্জিন ন্যূনতম রাখার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম বাজার তদারকি করছে। পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, গত বছরের পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করা চিহ্নিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না হওয়ায় এবারও তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ কারসাজি করে ভোক্তাদের পকেট কাটতে না পারে।
শ্যামবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম কমাতে হলে আমদানি পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা দরকার। তিনি বলেন, বিষয়টি খুব সহজ। একজন আমদানিকারক তার পেঁয়াজ কবে দেশে এনেছেন, কত টাকায় এনেছেন, কত টাকায় বিক্রি করেছেন, আর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণার দিন কত টাকায় বিক্রি করেছেন। সেখানেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে কারা পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করে রেখেছেন।
এছাড়া বুধবার পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা। এ সময় তিনি বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে যারা অসাধুতা করেছে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হবে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সুযোগ বুঝে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা বন্ধের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রতিযোগিতাবিরোধী যদি কোনো কার্যক্রম হয় তাহলে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলব।
আন্দালীব
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: