বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলে শুধু শুক্রবারে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২২ ২০:৫০; আপডেট: ৩ অক্টোবর ২০২২ ২০:৫২

ছবি: সংগৃহিত

সপ্তাহে ১ দিন এবং মাসে চার দিন ক্লাস কার্যক্রমেই চলছে রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি (আরএসটিইউ)। এমন তথ্যই মিলেছে নাটোরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে। খবর বণিক বার্তার।

পাঠ্যসূচিতে নির্ধারিত বিষয়গুলো শেষ করতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে চার থেকে পাঁচদিন ক্লাসে যেতে হয়। এর পরও নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেডিট সম্পন্নে বেগ পেতে হয় বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির শিক্ষার্থীদের। যদিও এক্ষেত্রে ‘অদ্ভুত’ এক নীতি অনুসরণ করছে নাটোরের রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি (আরএসটিইউ)। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ একাডেমিক কার্যক্রমই পরিচালিত হচ্ছে শুক্রবার। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি টানা ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় প্রায় শিক্ষার্থীশূন্যই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা ভবনটি। এতে অনেকটা সাপ্তাহিক ছুটির দিননির্ভর হয়ে পড়েছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আরএসটিইউর শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সহজ প্রক্রিয়ায় সনদ প্রদান করায় চাকরিজীবী ডিগ্রিপ্রার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন চাকরিরত। দূর-দূরান্ত থেকে আগত কর্মজীবী এসব শিক্ষার্থীর সুবিধার্থেই শুক্রবার সপ্তাহের সব ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে একদিন ক্লাস করিয়ে চার বছরের মধ্যে স্নাতক ডিগ্রির সব ক্রেডিট সম্পন্ন করা কোনোভাবে সম্ভব নয়। বোর্ড অব অ্যাক্রিডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশনের (বিএইটিই), বাংলাদেশের টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সালেকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচদিন ক্লাসে যেতে হয়। ট্রাইমেস্টারের ক্ষেত্রে সেটি চারদিন। তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে ক্রেডিট বেশি থাকায় ক্লাসের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। সিএসই ও ইইইর মতো বিষয়গুলোয় প্রতি সপ্তাহে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক মিলিয়ে ১২-১৬ ঘণ্টার ক্লাস থাকে। একদিনে সব ক্লাস নেয়ার বিষয়টি খুবই অদ্ভুত, অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। এ প্রক্রিয়ায় সময় পার করে সনদ প্রদান সম্ভব হতে পারে, কিন্তু গুণগত মানের পাঠদান কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

শুক্রবার ও সপ্তাহের অন্য কর্মদিবসে শিক্ষা কার্যক্রমের তুলনামূলক চিত্র দেখতে সম্প্রতি নাটোরে বিশ্ববিদ্যালয়টি সরেজমিন পরিদর্শন করে বণিক বার্তা। এতে দেখা যায়, সপ্তাহের সাধারণ কর্মদিবসগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ থাকে বেশ নীরব। এ সময় বিভিন্ন বিভাগে কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে আসতে দেখা গেলেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা গিয়েছে সামান্যই। অন্যদিকে বিপরীত চিত্র দেখা যায় শুক্রবারে। ছুটির এ দিনটিতে টানা বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়।

পার্শ্ববর্তী একটি জেলা থেকে শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ক্লাস করতে আসা এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি ডিপ্লোমা ডিগ্রি সম্পন্ন করে প্রকৌশলী হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। পদোন্নতির প্রয়োজনে আরএসটিইউতে বিএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছি। এখানে ক্লাসে অংশগ্রহণের বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়। যখন সময়-সুযোগ হয় ক্লাসে অংশ নিই।’ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার দোকানি ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেও শুক্রবারকেন্দ্রিক এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সত্যতা মেলে। তাদের ভাষ্য, ‘এখানে শুক্রবার ক্লাস-পরীক্ষা হয়। অন্য দিনগুলোতে আশপাশের দুএকজন স্টুডেন্ট আসেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রমের গুণগত মান নির্ণয়ে সম্প্রতি অ্যাক্রিডিটেশন কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল। প্রতিষ্ঠানটির ফ্রেমওয়ার্কে ক্রেডিট আওয়ারের সংজ্ঞা বিষয়ে বলা হয়েছে, লেকচার, টিউটোরিয়াল ও সেমিনারের ক্ষেত্রে এক ক্রেডিট বলতে ১৪ সপ্তাহের সেমিস্টারে প্রতি সপ্তাহে ১ ঘণ্টার ফেস টু ফেস পাঠদানকে বোঝায়। আর ল্যাব, স্টুডিও বা ক্লিনিক্যাল কাজের ক্ষেত্রে এক ক্রেডিট বলতে ১৪ সপ্তাহের সেমিস্টারে প্রতি সপ্তাহে দেড় ঘণ্টার ফেস টু ফেস পাঠদানকে বোঝায়। সে হিসেবে ১২ থেকে ১৬ ক্রেডিটের সেমিস্টারে সপ্তাহে ১২-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ক্লাস থাকতে পারে।


এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ড. সঞ্জয় অধিকারী বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি সপ্তাহে একদিন পড়িয়ে বিএসসি ডিগ্রি দেয়, তাহলে বুঝতে হবে শিক্ষার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। কারণ কোনো মানদণ্ডেই এ পদ্ধতিতে নির্ধারিত ক্রেডিট আওয়ার সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উচিত এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তবে আরএসটিইউর বিরুদ্ধে নিম্নমানের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ নতুন নয়। বছর কয়েক আগে মাত্র ১৭ মাসে একজন ব্যক্তিকে বিএসসির সনদ প্রদানের প্রমাণ মেলে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তদন্তে। অবৈধ সনদ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আকস্মিক পরিদর্শনে যায় ইউজিসির একটি প্রতিনিধি দল। পরিদর্শন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় তদন্ত কমিটি। অবৈধ সনদ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এক বছর পাঁচ মাসের মধ্যে কীভাবে চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স প্রদান করা হলো এবং ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বরিশাল সিটি করপোরেশনে কর্মরত অবস্থায় নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেন—এরূপ প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তিনি কমিটির কাছে স্বীকার করেন, এ জাতীয় আরো অনেক সনদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইস্যু করেছে। এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে সনদ দেয়া হয়েছে বলে কমিটিকে অবহিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সুমন চন্দ্র দাস।’

ওই পরিদর্শনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার সুষ্ঠু কোনো পরিবেশ খুঁজে পায়নি ইউজিসির প্রতিনিধিদল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ তলাবিশিষ্ট ভাড়াকৃত ভবনের নিচতলায় গাড়ি মেরামতের গ্যারেজসহ দোকানপাট থাকায় শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। পরিদর্শনকালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র তিনটি ল্যাবরেটরি থাকলেও এগুলোয় উল্লেখযোগ্য কোনো যন্ত্রপাতি নেই। শ্রেণীকক্ষগুলোয় ধুলাবালি জমে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস পরিচালিত হয় না বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা অপর্যাপ্ত ও পড়ালেখার অনুকূল পরিবেশও অনুপস্থিত ছিল।

শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে পরবর্তী সময়ে ইউজিসির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চিঠি দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত একই ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটি। আগের সেই ভবনেই নিম্নমানের ল্যাব নিয়ে সিএসই ও ইইইর মতো বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নেই। আর উপাচার্য থাকলেও বেশ কয়েক মাস ধরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন।

অনুপস্থিতি ও অন্য বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল গাফফার মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব বিষয়ে কথা বলতে সম্মত হননি। আর রেজিস্ট্রার কেএম আবদুল মুমিনের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘উপাচার্য স্যার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। উনি অসুস্থ থাকায় ছুটিতে রয়েছেন। আপনি যেসব বিষয়ে জানতে চান, সে বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, সপ্তাহে একদিন পড়িয়ে চার বছরে স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রি প্রদান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উত্থাপিত বিষয়টি সত্যি হলে অবশ্যই সে আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত শিক্ষা ও গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানোর বিষয়ে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর উচিত তা অনুসরণ করা। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানই টেকসই ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারে না।

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top