বিএনপির ‘আতঙ্কিত’ নেতারা পদ রক্ষার দৌড়ঝাঁপে

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৪ ১১:০৬; আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৪৩

ছবি : ফাইল

দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রদবদল ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরে চলছে নানামুখী তৎপরতা। বিগত আন্দোলনে প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় এরই মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পদ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা। সেই ধারাবাহিকতায় স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন স্তরে আরও পরিবর্তন আনা হতে পারে। এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন বয়োজ্যেষ্ঠ ও আলোচিত অনেক নেতা। নিজ নিজ পদ ও দলে সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে তাদের অনেকেই নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, দলকে শিগগির আন্দোলনমুখী করার পরিকল্পনা সামনে রেখে সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবেই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদলের পাশাপাশি ঢাকাসহ চার মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ভেঙে দেওয়া হয়েছে যুবদলের কেন্দ্রীয় এবং ছাত্রদলের ঢাকা মহানগরের চার কমিটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিএনপিতে আরও রদবদলের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় শূন্য পদ পূরণ ছাড়াও ‘টপ টু বটম’ তথা সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির সহসম্পাদক পর্যন্ত নানান স্তরে পরিবর্তন আনা হবে। পুনর্গঠনের দ্বিতীয় ধাপে শিগগির ৩০ থেকে ৩৫ জনকে স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানান পদে পদায়ন করা হতে পারে। এরপর তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াইশ পরিবর্তন আসতে পারে। ‘আস্থাভাজন’ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। একই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটিও গঠন করা হবে। পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়ায় দলীয় ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় কোনো নেতাই রেহাই পাবেন না।

জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কমিটি গঠন, পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক প্রয়োজনেই দলে বিভিন্ন সময় শূন্য পদ পূরণ, ছোটখাটো রদবদল করা হয়। এবারও সেটা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আগামীতে সংগঠন আরও সুসংহত, গতিশীল হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংগঠনে প্রত্যেকের একটা জবাবদিহি থাকে। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি সেটা সঠিকভাবে পালন না করলে সেক্ষেত্রে বেটার রিপ্লেসমেন্ট মাস্ট।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রদবদলের এই প্রক্রিয়া নিয়ে আতঙ্কে আছেন সিনিয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা। এরই মধ্যে তারা পদ রক্ষার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। কেউ কেউ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সুদৃষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেক নেতা। বিভিন্ন মাধ্যমে শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে দলে সম্মানজনক অবস্থান বজায় রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন তারা। তাদের পাশাপাশি সামনের রদবদলে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্যও অনেকে হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। নতুন করে নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পেতেও চলছে লবিং-তদবিরসহ বিভিন্ন তৎপরতা।

জানা গেছে, রদবদলের প্রথম ধাপে ৪৫ জনকে নির্বাহী কমিটির নানান পদে পদায়নের পর বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। আর ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে শূন্য পদ রয়েছে ১২টি। এসব পদে নতুন মুখ আনা হবে। বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে দু-একজন নিষ্ক্রিয় হলেও স্থায়ী কমিটি থেকে আপাতত কাউকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। সংগঠনকে গতিশীল করতে দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকা পদগুলো পূরণ করাই প্রধান টার্গেট দলের।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একদফা দাবিতে এক বছরের বেশি আন্দোলন করে বিএনপি। তবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বলে মনে করে দলটি। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে আগামী দিনের আন্দোলন সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়াতে সাংগঠনিক অ্যাকশনে নামে বিএনপির হাইকমান্ড। গত ১৩ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর বিএনপির সঙ্গে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিলুপ্ত করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের কমিটিও। এরপর ১৫ জুন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদলের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির বদলে নতুন দুটি কমিটি গঠন করে বিএনপি। একই দিন ছাত্রদলের ২৫৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটিও ঘোষণা করা হয়।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেই বিলুপ্ত সব ইউনিটের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। এসব কমিটিতে শীর্ষপদ পেতে শেষ মুহূর্তের লবিং-তদবিরে ব্যস্ত রয়েছেন পদপ্রত্যাশীরা। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে পছন্দের ব্যক্তিদের জায়গা নিশ্চিত করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। দলের হাইকমান্ডকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তারা।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বয়স্করা মহানগরের নেতৃত্ব দিলেও এবার তরুণদের ওপর আস্থা রাখতে চায় হাইকমান্ড। মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি পদে বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। উত্তরের নেতাকর্মীরাও তাকে সভাপতি হিসেবে চান। আমিনুলের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীরের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব গত শুক্রবার কারামুক্ত হওয়ায় দলের প্রভাবশালী একটি মহল তাকে সভাপতি করতে জোরালোভাবে মাঠে নেমেছেন। তারা নীরব ও জাহাঙ্গীরকে দিয়ে কমিটি গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

অবশ্য বিদায়ী কমিটির মূল নেতাদের রেখেই মহানগর উত্তর বিএনপির নতুন কমিটি গঠনের জোরালো দাবিও রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে দলের হাইকমান্ডের কাছে এরই মধ্যে এই দাবি জানিয়েছেন বিদায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা। এদের বাইরে সাধারণ সম্পাদক পদে বিদায়ী কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন, এজিএম শামসুল হক, আতাউর রহমান চেয়ারম্যান, মোস্তফা জামান, আক্তার হোসেন এবং উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কফিল উদ্দিন আহমেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। উত্তরের বিদায়ী কমিটির দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা সদস্য এ বি এম এ রাজ্জাকও পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এদের বাইরে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য তাবিথ আউয়ালের নামও শোনা যাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই তার জন্য শিরোধার্য। তিনি সে অনুযায়ীই কাজ করবেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাকে যেখানে রাখবেন, সেখানেই তিনি সংগঠনের জন্য কাজ করে যাবেন।

উত্তর বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রত্যাশী এম কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মহানগরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছি। পদের প্রতি কখনো নজর ছিল না। পদে থেকে কিংবা পদ ছাড়াও বছরের পর বছর দলের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। আগামীতেও সংগঠনের জন্য কাজ করতে চাই। দল যখন যেখানে কাজে লাগাবে, সেখানেই কাজ করার জন্য প্রস্তুত আছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদায়ী কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে সভাপতি ও যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিনকে সাধারণ সম্পাদক অথবা সাবেক সহসভাপতি হামিদুর রহমান হামিদ ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রশিদ হাবিবকে নেতৃত্বে রেখে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নতুন কমিটি গঠনের সম্ভাবনা বেশি। আবার এই চারজনকেই নতুন কমিটিতে রাখা হতে পারে। এর বাইরে শীর্ষ পদের জন্য সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সিনিয়র সদস্য ইশরাক হোসেনের নামও আলোচনায় রয়েছে।

এদিকে যুবদলের বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নার নতুন কমিটিতে সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মী তাকেই সভাপতি হিসেবে চান। এরই মধ্যে সারা দেশে নেতাকর্মীদের মধ্যে তার রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সভাপতি হিসেবে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসানের নামও আলোচনায় রয়েছে। অন্যদিকে শীর্ষ পদের দৌড়ে বিদায়ী কমিটির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টনও রয়েছেন। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানকেও যুবদলের সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে। এদের বাইরে সুপার ফাইভের আলোচনায় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান শ্যামল ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলের নাম আলোচনায় রয়েছে।

যুবদলের সদস্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না বলেন, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি সারা দেশে সংগঠনকে সুসংহত, শক্তিশালী ও গতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে যুবদলের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ সাংগঠনিক সামর্থ্য অনুযায়ী রাজপথে ছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাকে আগামীতে যেখানে রাখবেন, সেখানে থেকেই সংগঠনের জন্য কাজ করে যাবেন।



বিষয়: বিএনপি


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top