তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড, নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৪৫; আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৬

ছবি: সংগৃহীত

আবহাওয়া অধিদফতর বলছে— চুয়াডাঙ্গা, যশোর এবং পাবনার ওপর দিয়ে ‘অতি তীব্র’ তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খুলনা বিভাগের বাকি অংশ, রাজশাহী জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের বাকি অংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় রোববার (২১ এপ্রিল) দুপুর নাগাদ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি। এছাড়া রাজশাহীতে ৪১ দশমিক ৫, খুলনায় ৪১ দশমিক ২, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪২, চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৪ এবং যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছে, দেশের ওপর দিয়ে চলমান মৃদু থেকে তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

১৯ এপ্রিল থেকে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উচ্চ তাপমাত্রার ফলে দেশজুড়ে জনজীবনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। তাপপ্রবাহে দুর্ভোগ এড়াতে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের স্কুল-কলেজ। করোনাকালীন দুর্যোগের মতো অনলাইনে ক্লাস নেওয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাসের ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়াবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদেরা। তারা বলছেন— যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক বছরে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার এমন বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তাপমাত্রার এমন বৈরি আচরণের জন্য অপরিকল্পিত নগরায়নেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

দেশি এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, শুধু ঢাকাতেই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স ওই সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। গরম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে— গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটারের সমআয়তনের জলাধার ও ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান মনে করেন, এটা শুধু ঢাকার চিত্র নয়। তিনি বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন উঠেই চলেছে। নগরগুলোর প্রতিটি ভবন পরিকল্পিত না হলে এবং এলাকাগুলোতে সবুজের ভারসাম্য আনা না হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।

তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড

গত কয়েক বছর ধরে দেশে দাবদাহ বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন নতুন রেকর্ড হয়েই চলেছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল আগের ২৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড হয়েছিল। ওইদিন দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে শনিবার (২০ এপ্রিল)। এদিন যশোরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি। যদিও এক সাথে অনেকগুলো জায়গায় ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে এবার।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে— প্রতিদিন কোনো এক জায়গার গড় তাপমাত্রা যা থাকে তা থেকে ৫ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচদিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। তবে অনেক দেশ এটিকে নিজের মতো করেও সংজ্ঞায়িত করে।

বজলুর রশীদ একজন আবহাওয়াবিদ। তিনি বলেছেন, দেশে দাবদাহ আগে এপ্রিল-মে মাসে অনুভূত হতো। জুনে বৃষ্টি শুরু হলে ধীরে ধীরে তা কমে যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে আগস্ট পর্যন্ত তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এমনকি গত ১০/১২ বছরে শীতকাল বা শীতের দিনের সংখ্যাই কমে গেছে।

আবহাওয়া দফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। তবে এটা পুরো নির্ভর করে মানবদেহের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর।

এদিকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের এক গবেষণায় ৪৪ বছরের তাপমাত্রার একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়।

তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনা সম্ভব?

আবহাওয়া ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে— প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। এর জন্য উন্নত বিশ্বের বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবেশের অযৌক্তিক ক্ষতি করাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এখন ভবনগুলোর ডিজাইনই হচ্ছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রেখে কিংবা শীতাতপ যন্ত্র যাতে বসানো যায় সে চিন্তা করে। অথচ আগে অনেক ভবন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে গরমকালে শুধু ফ্যানেই কাজ হতো।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জলবায়ু নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষ করে মেট্রো রেলের মতো বিদ্যুৎ চালিত গণপরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব ভবননির্মাণ করতেই হবে।

তিনি বলেন, খাল, পুকুর-সব ভরাট হয়ে গেছে। জলাধার নেই। এগুলোই তো সাময়িকভাবে তাপমাত্রা কমাতে দরকার হয়।

তবে নগরায়নের পাশাপাশি শহরগুলোকে কীভাবে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করা যায়, সে পরিকল্পনার ওপর জোর দেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে নগরায়ন বাড়বে। কিন্তু শহরগুলোকে একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় এনে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গ্রিনারি বা সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, শহরগুলোর জনসংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের সুবিধাগুলোকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে জনসংখ্যায় ঘনত্ব কমাতে হবে। পাশাপাশি ভবনগুলোকে পরিবেশ বান্ধব করতে হবে।

কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে

ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ খান বলছেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে এবং বনায়ন করতেই হবে। বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো ধ্বংসাত্মক নগরায়ন। ঢাকার এমন ওয়ার্ড আছে যেখানে ৯০ ভাগই কংক্রিট। গরম বেশি অনুভূত হয়। কারণ নগর এলাকায় গাছপালা, জলাধার ধ্বংস করা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত ওপেন স্পেস রাখতেই হবে।

তার মতে— নগরায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সবুজের পরিমাণ বাড়িয়ে নগরের ২৫-৩০ ভাগ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ভবনগুলোর চারদিকে স্পেস বা খালি জায়গা রাখতে হবে এবং এলাকাভিত্তিক পুকুর বা জলাধার রাখতে পারলে তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি রাজউক একটি নীতি প্রণয়ন করেছে - যেখানে প্লটের আকার ভিত্তিক গাছের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ খান মনে করেন, এটি কার্যকর হলেও কিছুটা কাজে আসবে। যত বেশি সবুজায়ন হবে ততই তাপমাত্রা সহনীয় হবে। জলাধার থাকতেই হবে। পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যকার দূরত্ব এবং প্রতিটি ভবনের পরিবেশ বান্ধব ডিজাইন করতে হবে। একই সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শীতাতপ যন্ত্র ব্যবহার হতে হবে নিয়ন্ত্রিত।

সূত্র: বিবিসি



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top