জন্ম নিচ্ছে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ও গ্যাং কালচারের মত নানান অপরাধ

ক্ষতিকর অ্যাপ ব্যবহারে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৩২; আপডেট: ৪ অক্টোবর ২০২০ ১৬:১২

ফাইল ছবি

প্রযুক্তির উৎকর্ষতা যত বাড়ছে ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশে তরুণ সমাজের বিপথগামীতা। বিশেষ করে ক্ষতিকর অ্যাপস ব্যবহারে কমে যাচ্ছে নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

দেশে যেমন ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটছে তেমনি পাড়া মহল্লায় তৈরী হচ্ছে কিশোর গ্যাং। বর্তমানে ‘বিগো লাইভ’, ‘টিকটক’, ‘লাইকি’ নামক অ্যাপগুলি উঠতি বয়সের তরুণদের করছে বিপথগামী।

অ্যাপগুলি ব্যবহারে সরাসরি কোন অপরাধ না করলে ও পরোক্ষভাবে তা অপরাধে সংযুক্ত হতে উস্কে দিচ্ছে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীদের নজরদারি করা হলেও সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

যৌনতার এক ভয়াবহ ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে 'বিগো লাইভ'। এই অ্যাপ এর মাধ্যমে তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করে লাইভে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দিয়ে বিকাশে টাকা পাঠানোর আহ্বান জানান কিছু নারী। যৌনতার ফাঁদে ফেলে কৌশলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেন তারা।

অ্যাপটির ফাঁদে সবচেয়ে বেশী শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। মূলত পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকায় এবং একাকিত্ব দূর করতেই বেশির ভাগ প্রবাসী যুবক এই অ্যাপটির টেক্সট ও ভিডিও চ্যাটে তরুণীদের সঙ্গে আলাপে উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

এমনকি অ্যাপের মাধ্যমে এসব বেড়াজালে জড়িয়ে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক তরুণ।

বিগো লাইভ মূলত একটি লাইভ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, যেখানে একজন ব্যবহারকারী তার ফলোয়ারের সঙ্গে লাইভে মুহূর্ত শেয়ার করেন।

উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে পড়ছে এই অ্যাপ। জানা যায়, ব্যবহারের দিক দিয়ে চলতি বছরের মার্চে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ এবং বিশ্বের পঞ্চম জনপ্রিয় লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপ। বাংলাদেশেও এরই মধ্যে তরুণ-তরুণীদের কাছে অ্যাপটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু অ্যাপটির অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানে অ্যাপটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তরুণদের সময় নষ্ট ও বিপথগামীতা করার আরেক নাম ‘টিকটক’ নামক চীনা ভিডিও শেয়ারিং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সার্ভিস। বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি মোবাইল অ্যাপ।

সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাপটি আলোচনায় আসে এই অ্যাপের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়া ‘অপু ভাই’ নামের এক কিশোরের ভিডিওর মাধ্যমে। অপু সবুজরঙা চুল, নারীবিদ্বেষী আপত্তিকর কথা এবং অদ্ভুত ভাবভঙ্গি দিয়ে তৈরি করা ভিডিও পোস্ট করে অল্প সময়ে খ্যাতি পান। নতুন প্রজন্মের কাছে অপু দ্রুত হয়ে ওঠেন সেলিব্রেটি।

খুব সহজে স্বল্প সময়ে দ্রুত সেলেব্রেটি বনে যাওয়া অপু ও তার সহযোগীরা ঢাকার উত্তরায় আগস্ট মাসে রাস্তা আটকে আড্ডা দেওয়ার সময় এক গাড়িচালকের সঙ্গে বিতন্ডায় জড়ান। পথ ছাড়তে বলায় সেই চালকের ওপর চড়াও হন অপুর সহযোগীরা।

পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে রাতারাতি সেলেব্রেটি হওয়া এই অপুকে।

চটকদার ও আকর্ষণীয় করে তুলতে উদ্ভট রঙে চুল রাঙিয়ে এবং ভিনদেশি অপসংস্কৃতি অনুসরণ করে তৈরী করা ভিডিগুলোকে অনুসরণ করেছেন কিশোররা যাতে সহিংস ও কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট থাকে। এসব ভিডিও তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কিশোরী ও তরুণীরা। স্বল্পবসনা তরুণীরা টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ-গান ও অভিনয়ের পাশপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিডিও আপলোড করছেন।

নিছক বিনোদনের বশে করা এই ভিডিওগুলোতে নেই কোনো শিক্ষণীয় বার্তা। উল্টো এসব ভিডিওর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই অ্যাপটির অপব্যবহারের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার বিব্রতকর, অনৈতিক ও অশ্লীল ভিডিও, যা পর্নোগ্রাফিকে উৎসাহিত করে, তা প্রচার করায় বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানে এরই মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে টিকটক।

উঠতি বয়সের কিশোরদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মূলত ভিডিওগুলো তৈরী হয়। সাধারণত এই অ্যাপগুলোর মধ্যে এক ধরনের ‘শো অফ’-এর বিষয় থাকে। দেখা যায় টিকটকের কিছু ভিডিওতে বাইক-স্টান্ট থাকছে। আবার কিছু ভিডিওতে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের অনুকরণ করা হচ্ছে। ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও টিকটক অ্যাপ ব্যবহার করে। তারা সেখানে গ্রুপ করে যুক্ত করে অন্য সদস্যদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে বেশকিছু টিকটিক ভিত্তিক কিশোর গ্রুপ আছে। মোহাম্মদপুরে একটি কিশোর গ্রুপ আছে, যারা টিকটক গ্রুপ নামেই বেশি পরিচিত। গ্রুপটির নাম ‘ল্যারা দে’। গ্রুপটি ক্রমেই সন্ত্রাসী গ্রুপে পরিণত হচ্ছে। এই গ্রুপটি প্রধানত টিকটকভিত্তিক গ্রুপ। তারা টিকটকে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করে অন্য কিশোরদেরও এই গ্রুপে সংযুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।

বিগ লাইভ এবং টিকটকের পরই আলোচনায় চলে আসে আরেক ক্ষতিকর অ্যাপ ‘লাইকি’ সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই শর্ট ভিডিও ক্রিয়েশন এবং শেয়ারিং প্লাটফর্মে গিয়ে তরুণ প্রজন্ম অশ্লীল ভিডিও ছাড়ছে। আবার ইমোর মতো অ্যাপ, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী অডিও ও ভিডিও কলের সুবিধা নিয়ে থাকে, সেখানেও আপত্তিকর ভিডিওর ছড়াছড়ি। ইমো নম্বর বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে পোস্ট দিয়ে কিছু তরুণী অনৈতিক কার্যক্রমও করছেন। এর ফলে সচেতন ব্যবহারকারীকে প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে।

এসব ক্ষতিকর অ্যাপের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা হয় র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাথে। তিনি বলেন, ‘টিকটক, লাইকি, বিগো লাইভের মতো অ্যাপগুলো সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। র‌্যাবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সাইবার মনিটরিং করা। আমাদের একটি বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক সাইবার জগতে মনিটরিং করে। লক্ষ করেছি, বেশ কিছু অ্যাপ উঠতি বয়সের কিশোরদের একরকম বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অ্যাপগুলো বন্ধ করার জন্য প্রকৃত সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট যারা বিষয়টি মনিটরিং করছেন, তারা চাইলে এসব অ্যাপ বন্ধ করা যেতে পারে। পাশের দেশ ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে এ ধরনের অ্যাপ বন্ধ হতে দেখেছি। এসব অ্যাপ কিশোরদের নৈতিকতা ধ্বংস করছে। কিশোর-কিশোরীদের বিপদের দিকে পরিচালিত করছে। এ ছাড়া এসব অ্যাপের মাধ্যমে তরুণরা ক্রমান্বয়ে সহিংস হয়ে উঠছে। ’

সরাসরি ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে তাদের কর্মকান্ড না পড়ায় প্রাথমিকভাবে এসব কিশোর-তরুণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার কথা ও জানান তিনি।

  • এসএইচ

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top