ফোনে আড়িপাতা, নজরদারি থেকে বের হয়ে আসার কী উপায়?

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২৪ ২৩:০৩; আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:১০

ছবি: সংগৃহীত

গত দেড় দশকের আওয়ামী লীগ শাসনামলে মোবাইলফোনে আড়িপাতা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ সামনে এসেছে বেশ অনেকবার। বড় আলোচনার জায়গা ছিল সরকারি পর্যায়ে এমন তথ্য প্রযুক্তির কেনাকাটা নিয়ে যেগুলো নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হয়।

এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো আলোচনা হচ্ছে যে আগের মতো আড়ি পাতা ঠেকানো, বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করা কিভাবে সম্ভব হবে? সেসব প্রযুক্তির অপব্যবহার কীভাবে ঠেকানো হবে?

এ নিয়ে ২৪ আগস্ট একটি নাগরিক সংলাপের আয়োজনও করা হয়, যেখানে প্রায় সবাই পুরো ব্যবস্থাটি নিয়ে খোলামেলাভাবে সমালোচনা করেন।

সেক্ষেত্রে ‘নতুন বাংলাদেশের’ প্রেক্ষাপটে দুই ধরনের মতের প্রাধান্য দেখা গেছে। কেউ মনে করছেন সেসব সংস্থা এসব কাজে নিয়োজিত ছিল তাদের পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে হবে।

আবার অনেকের মত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে এর প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে করতে হবে যাতে করে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় না ঘটে।

সমস্যা যেসব জায়গায়

বাংলাদেশে আইন করেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যেকোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার’ সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা সংস্থার কাছে বা এদের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দিতে পারে।

মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্সের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সবশেষ নীতিমালাতেও বলা হয়েছে যে কল ডিটেইলড রিপোর্ট, ট্রাঞ্জ্যাকশন ডিটেইলড রিপোর্ট, নেটওয়ার্ক ট্রাফিক ডেটা এমন নানাবিধ তথ্য তদন্ত বা কমিশনের আইনানুগ প্রয়োজনে দুই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করবে। কল রেকর্ডের বাইরে আইপি এড্রেসসহ ডেটা সেশনের তথ্য ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করবে।

অর্থাৎ অন্তত দুই বছর পর্যন্ত ফোনের রেকর্ড, ছয় মাস পর্যন্ত ইন্টারনেট ডেটা রেকর্ড মোবাইল অপারেটরদের রাখতে হবে। ক্ষেত্র বা ব্যক্তিবিশেষে সে নির্ধারিত সময় পার হলেও আরো বেশি সময় ধরে সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়তে পারে। সেই এখতিয়ারও সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে।

আইনের সে ধারা অথবা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো দিকে নিরাপত্তার বিবেচনার কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোকে ভিন্নমত দমন এবং সরকার বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মতো মৌলিক অধিকার পরিপন্থী।

এছাড়া যেসব প্রযুক্তি কেনা হয়েছে তার পেছনে রাষ্ট্রীয় খরচও একটি দিক। যেমন ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ এর একটি প্রতিবেদনে ২০২২ সালে স্পেয়ারহেড নামের প্রযুক্তি বাংলাদেশে সরবরাহের কথা নিয়ে আলোচনা হয় ২০২৩ সালে। সেখানে শুধু এই একটি শিপমেন্টের খরচই ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

জনগণের টাকায় এমন কী ধরনের প্রযুক্তি কেনা হয়েছে তার কোনো কিছুই প্রকাশ করেনি বাংলাদেশের সরকার। স্বচ্ছতা না থাকায় এসব খাতে কতটা দুর্নীতি হয়েছে এমন বিষয়ে ক্ষোভের দিকটাও উঠে আসে নাগরিক সংলাপে।

আড়িপাতা সংস্থাগুলি বিলুপ্তির দাবি

এমন নজরদারির কাজে নিয়োজিত দু’টি সংস্থার কথা উঠে আসে যার একটি টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকমিউনিকেশন (ডিওটি)। এ দুটি সংস্থাকে বিলুপ্ত করা প্রয়োজন মনে করছেন অনেকে।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন ক্ষমতা ধরে থাকতে এবং দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ এবং কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

তার মতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সরকারের ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয় এবং‘এনটিএমসির প্রয়োজন নেই’ এবং এসব সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর কোনো মানে হয় না।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ মোবাইলফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন এনটিএমসির বিলুপ্তি দাবি করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সংস্থাটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ শনিবারও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,‘বিটিআরসি একটা লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।’

তিনি জানান, বিটিআরসিকে স্বাধীন সার্বভৌম, সাংবিধানিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দাবি করেছিলেন তারা যেটিতে কর্ণপাত করা হয়নি।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক ও সম্প্রতি সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে উদ্বেগ রয়েছে সংস্থাটির কার্যক্রম ও সক্ষমতার দিকগুলো নিয়ে।

সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন,‘আমি সরকারের কাছে এনটিএমসি ও ডিওটির বিলুপ্তি চাই... যে প্রতিষ্ঠান ১৫ বছর আমার ওপরে নজরদারি করেছে, আড়ি পেতেছে সে ব্যক্তি রয়েছে, সে যন্ত্রপাতি রয়েছে, সে অভ্যাস রয়েছে, তাকে আপনি কিভাবে সংস্কার করবেন?’ সেসব বাজেট স্কুল এবং স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

তথ্য প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘এনটিএমসি বা ডিওটি থাকার প্রয়োজন নেই, যদি থাকেও তাদেরকে সম্পূর্ণ পুনর্গঠন করতে হবে, শুধু লোক বদলে হবে না।’

সংস্কারের দাবি

নজরদারি বা আড়িপাতার প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে রয়েছে এমন বিষয়টিও তুলে ধরেন অনেকে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে যেখানে নিয়মকানুনের সঠিক প্রয়োগ রয়েছে সেখানে সেসব নজরদারি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয়, নাগরিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো ঘটে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বি এম মইনুল হোসেনের মতে, আইনগত নজরদারি পুরোপুরি বন্ধ করাটা বাস্তবসম্মত না, এই দুই বিভাগ বন্ধ করা হলেও গোয়েন্দা বা অন্যান্য বিভাগও এই কাজ অব্যাহত রাখতে পারে।

তবে নজরদারি আইনগত এবং অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেই হতে হবে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হতে হবে, অপব্যবহার বা অপরাধ সংঘটনের জন্য নয়। এক্ষেত্রে সংস্থার চেয়ে প্রক্রিয়ার ওপরে জোর দিয়ে নিয়মমাফিক অডিট, রিভিউ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন ড. হোসেন।

নতুন উপদেষ্টা পরিষদের সামনে এখন বহুমুখী সংস্কারের দাবি রয়েছে।

এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনলেও যেন ‘ডিএসএর জায়গায় সিএসএর মতো না হয়’ (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট) বলেন আইনজীবী মিতি সানজানা।

পুরো সিস্টেমে বড় পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা মানবাধিকার খর্ব করার মতো দিকগুলো নীতিমালা থেকে বিলুপ্ত করা বা পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেন তিনি।

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সারা হোসেনও মনে করেন কিছু আড়িপাতার প্রয়োজন থাকতে পারে, সব আড়িপাতা তুলে দেয়া যাবে এমন না, কিন্তু আড়িপাতার মাধ্যমে যে তথ্য বা ডেটা নেয়া হয় তা বেআইনিভাবে ব্যবহার করা যাবে না, প্রকাশ করা যাবে না।

আইনগত সংস্কারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘আমাদের যে আইনগুলো তৈরি হয়েছে যেগুলো আমাদের বাকস্বাধীনতাকে রোধ করছে, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলাগুলো এখনো চলছে, ব্রিটিশ আমলের ফৌজদারি আইনে মানহানির মামলা করার সুযোগ রয়েছে, এসবগুলো আমাদের তুলে দিতে হবে।'

‘আড়ি পাতার বিষয়ে আমাদের যে আইন রয়েছে এটা নিয়ে একটি রিট আমাদের সুপ্রিম কোর্টেও ছিল, এটা নিয়ে আবারো কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে, যারা সরকারে আছেন তারাও দেখতে পারেন এটা কিভাবে ঠিক করা সম্ভব।’

আগের ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য মোট ভিন্ন ধরনের হলেও অন্তত এসব বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার দিকটি নাগরিক সংলাপের একটি লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

আরো কিছু ইস্যু

সেই অনুষ্ঠানে শুধু সরকারি নজরদারি না, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আরো কিছু দিক নিয়ে আলোচনা হয়।

যেমন ব্যবসায়ী বা বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যেভাবে মানুষের আলোচনা থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন দেখায় সেসব দিকও বাংলাদেশে সঠিক নিয়মনীতির অনুপস্থিতির কারণে হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্রসহ যেসব জায়গায় ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয় সেসবের সুরক্ষার জায়গাতেও ঘাটতির কথা উঠে আসে। ডেটা প্রটেকশনের বা তথ্য সুরক্ষার এবং কনসেন্ট বা অনুমতির জায়গাগুলো দৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তার কথাও আসে।

পরিষ্কার আইনগত কাঠামো, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত করার দিকে জোর দেয়ার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেন অনেকেই।

এখন এসব কিছুর অনেকটাই নির্ভর করছে সরকারের ওপর। যদিও বর্তমান মধ্যবর্তী সরকারের সামনে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের প্রসঙ্গ আসছে।

এ অনুষ্ঠানে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ত্রাণের কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি বলে জানানো হয়। তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও শনিবার তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সূত্র : বিবিসি



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top