কুকুর-বিড়ালের ভাষা বুঝেন রাবির কর্মচারী গাজীউল
রাবি প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ২২ জুলাই ২০২২ ০৭:৩৪; আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ১১:৪১
-2022-07-21-21-33-06.jpg)
মানবিকতার জায়গা থেকে ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪ বছর যাবত ক্যাম্পাসের পশুপাখিকে নিজের অর্থায়নে সেবা করে যাচ্ছেন। খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে প্রায় বেতনের একতৃতীয়াংশ টাকা পশুপাখির পিছনে চলে যায়। প্রতিদিন সকলের একটা অংশ কাটে পশুপাখির সাথে।
কুকুর ও বিড়ালের ভাষাও বুঝতে বাকি নেই তার। বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক (টিএসসি) কেন্দ্রের উচ্চমান সহকারী কর্মচারী গাজীউল ইসলামের কথা।
তার সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৪ বছর আগে ২০০৮ সালে নিজের অর্থায়নের মানবিক জায়গা থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পশুপাখির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রথমে নিজ অর্থায়নে শুরু করলেও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়ান।
পশুপাখির মধ্যে রয়েছে কুকুর, বিড়াল, শালিক, কবুতর। রাবি ক্যাম্পাসে ৬০ টির মতো কুকুর ও ১২টির মতো বিড়াল আছে। গাজীউলের বাসায় আরো ১৪ টি কুকুর ও ১৫০ টির মতো কবুতর আছে। ক্যাম্পাসে কিছু শালিক পাখিও রয়েছে তার।
গাজীউল সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে টিএসসিতে এসে এসব পশু-পাখির জন্য খাবার রান্না করেন। ক্যাম্পাসের ভিতরে ৯টি পয়েন্ট ভাগ করে এসব খাবার খাওয়ান পশুপাখিদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবন, রসায়ন বিভাগের পিছনে, লাইব্রেরি চত্বরের পাশে, প্রশাসন ভবনের সামনে, পরিববনের মার্কেটে, মতিহার হলের সামনে, মেডিকলের সেন্টারের পাশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্দিরের পাশে ও বিনোদপুর গেইটে দিকে এসব রান্না করা খাবার বিলি করতে প্রতিদিন ছুটে যান তিনি। ৬০ টি কুকুর ও ১২ টি বিড়ালের খাবারের রান্না থেকে শুরু করে খাবার খাওয়ানো পর্যন্ত তিন ঘন্টা সময় লেগে যায় গাজীউলের।
ক্যাম্পাসে কোনো ক্ষুদার্ত কুকুর বা বিড়াল দেখলেই তার মোটরসাইকেল থামিয়ে দোকান থেকে খাবার কিনে খাওয়ান এ সহকারী কর্মচারী। তিনি শুধু খাবার খাওয়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না অসুস্থ কুকুর বা বিড়ালকে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা সেবাও দিয়ে থাকেন। এমন সখ্যতার কারণে তার প্রিয় ভক্ত কিছু কুকুরের নাম দিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে শেফালী, মোটু, কালী, ফাটি অন্যতম। ওদের নাম বলে ডাকলেই দ্রুত চলে আসে তার কাছে।
গাজীউলের সাথে কথা বলে আরো জানা গেছে, পশুপাখির প্রতিদিনের খাবারের উপাদানের মধ্যে চাল, গরুর মাংসের চর্বি আর ডাল দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। প্রতিবেলা খাবারের মধ্যে থাকে ১০কেজি চাউল, ১ কেজি গরুর চর্বি যার খরচ পড়ে ৭০০ টাকা প্রায়। এতে প্রতি মাসে গাজীউলের ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এই অর্থায়নের অর্ধেক অংশই তার পকেট থেকে যায় আর বাকি অর্ধেক শিক্ষকদের কাছ থেকে আার্থিক সহযোগিতা পান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীউল বলেন, দীর্ঘ ১৪ ধরে এ কাজ করে আসছি। পশু-পাখির প্রতি মমত্ববোধের জায়গা থেকেই এ কাজ করছি। তাদের সাথে আমার এক সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আমার গাড়ি যেতে দেখলেই গাড়ির পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে তারা। মাজে মাজে আমাকে না পেয়ে আমার গাড়ির পাশে বসে থাকে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি প্রাণীর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। আমার এ কাজে অনেকেই সহযোগিতার হাতে বাড়িয়ে দিয়েছেন তার মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক ড. আমীরুল ইসলাম কনক ও হাবিবুর রহমান স্যার অন্যতম।
তিনি আরো বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার পশুপাখিদের প্রতি ভালোবেসে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন আমাকে। প্রয়োজন হলে আরো সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। অসহায় এ প্রাণীকুল রক্ষায় আমরা সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসি তাহলে পশুপাখিরাও নিরাপদে পৃথিবীতে বেচে থাকতে পারবে। পশুপাখিদের সহযোগিতা করতে সকলকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান এ উচ্চমান সহকারী কর্মচারী।
আর্থিক সহযোগিতা করে পশুপাখির পাশে দাঁড়িয়েছেন ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম কনক।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটা পরিবারের মতো তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পশুপাখিও রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে দোকান পাট বন্ধ থাকার ফলে পশুপাখিদের জন্য একটা কঠিন অবস্থা দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন থেকেই এদের পাশে থেকে কাজ করা। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যেমন দরকার তেমনি সকল জীবজন্তুর প্রতি আমাদের খেয়ার রাখা দরকার। এটি একটি মানবিক কাজ। এ কাজটি করে আমরা নিজেরাও আত্মতৃপ্তি লাভ করি। সকলেই এ কাজকে সাধুবাদ জানান এটাই আমাদের ভালো লাগা।
অনুদানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, করোনাকালীন সময়ে মানুষের খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। তার মধ্যেই গাজীউল পশুপাখিদের পাশে দাড়িয়েছে যা মানবতার পরম দৃষ্টান্ত। এখন ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকদিন বন্ধ থাকবে। ফাঁকা ক্যাম্পাসের পশুপাখিদের কথা চিন্তা করে আমি এই অনুদান দিয়েছি। আগে আমরা কুকুর দেখলে ডিল মারতাম, সাপ দেখলে মারতে যেতাম, পাখি দেখলে শিকার করতাম কিন্তু এখন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন আমরা চিন্তা করি এদেরকে সংরক্ষণ করা দরকার। পশুপাখি সংরক্ষনে মানবিক জায়গা থেকে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এ উপাচার্য।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: