রাবিতে ১৪১ জনের নিয়োগ: বৈধ না অবৈধ?

কে এ এম সাকিব, রাবি | প্রকাশিত: ১০ মে ২০২১ ০২:০৯; আপডেট: ১০ মে ২০২১ ০৭:৫৪

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য প্রফেসর এম আবদুস সোবহান গত ৫ মে তার মেয়াদের অন্তিম সময়ে  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১২ (৫) এর নির্বাহী ক্ষমতাবলে অ্যাডহকের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে ১৪১ জন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেন।

উপাচার্য সোবহানের মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুর কমিশন কর্তৃক তার বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা প্রমানিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে এক প্রজ্ঞাপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী নিয়োগসমূহে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে।

এদিকে একই দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এই নিয়োগ দেয়ায় সম্পূর্ন নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষনা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জড়িতদের চিহ্নিত করতে গঠন করেছে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটিও।

গত ৮ তারিখ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সরেজমিন তদন্ত করে গেলেও আনুষ্ঠানিক কিছু জানায় নি তারা।

ভিসি সোবহানের নির্বাহী ক্ষমতা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণায় ধূম্রজাল তৈরী হয়েছে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি সারাদেশে এটি বেশ আলোচিত হচ্ছে। 

এই বিষয়ে আইনগত মতামত নেয়া হয়েছে বেশ কিছু আইনের শিক্ষক ও আইনজীবীদের।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাদিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি রাজটাইমসকে বলেন, উপাচার্যের নির্বাহী ক্ষমতায় নিয়োগ স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্ষমতা সার্বভৌম নয় এবং তিনি অযৌক্তিকভাবে এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন না।

তিনি অ্যাডহকের ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন, কিন্তু যেসব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেসব বিভাগ থেকে শিক্ষক নিয়োগে প্লানিং কমিটির কোন সুপারিশ নেই।

তাছাড়া অ্যাডহক নিয়োগ দেয়া হয় 'জরুরী প্রযোজনে'। কিন্তু তিনি যেই মুহুর্তে এই নিয়োগ দেন তখন কার্যত কোন 'জরুরী প্রয়োজন' কিংবা 'ভ্যাকান্সি' কোন টাই ছিল না। এমতাবস্থায় এমন নিয়োগ সম্পূর্ন অযৌক্তিক।

এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট প্রজ্ঞাপন থাকার পরও এমন নিয়োগ আইনের প্রতি সম্পূর্ন অশ্রদ্ধা।

আইন বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ভিসির নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনকে উপাচার্য এড়িয়ে যেতে পারেন না। সুতরাং এটি বিধি সম্মত এবং নিয়মতান্ত্রিক ভাবে হয় নি বলেই মনে হচ্ছে।

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) একটি রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান। এটির নির্দেশনা উপেক্ষা করাও সমীচীন নয়।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি হলেও নির্বাহী বিভাগকে এভোয়েড করার সুযোগ নাই। কারণ, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে উনার উনার কার্য নির্বাহ করে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সিনিয়র শিক্ষক ও বিষয়টিকে বিধি সম্মত নয় বলেই স্বীকার করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সহায়তার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উনি (ভিসি) যে ধারাটির কথা বলছেন, সেটা যেভাবে বলছেন এবং যে কারণে বলছেন, সেখানে মনে হচ্ছে, তিনি খণ্ডিতভাবে ধারাটি উল্লেখ করছেন।

অধ্যাদেশ তাকে অস্থায়ী নিয়োগ দেয়ার যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেখানে কিন্তু সিন্ডিকেটকে অবগত করার কথাও বলা হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ৭৩ এর অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের রক্ষাকবচ। সে কারণে সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর অনেক ক্ষমতার অধিকারী হন। কিন্তু সেই ক্ষমতার চর্চার উদ্দেশ্যটা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বার্থে হওয়া উচিত। আর সে কারণেই ১২(২) ধারায় বিশ্বস্ততার কথা বলা আছে।

ওটা লঙ্ঘন করারও তো সুযোগ নেই।
১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের ১২(২) ধারায় বলা হয়েছে- এই আইন, সংবিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ যাতে বিশ্বস্তভাবে পালন করা হয় তা নিশ্চিত করা উপাচার্যের দায়িত্ব হবে এবং এই উদ্দেশ্যে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত ক্ষমতা থাকবে।

অধ্যাপক আবদুস সোবহানের দাবি অনুযায়ী, নিয়োগে নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের সংঘাত হয় কি না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা এভাবে বলা মুশকিল। মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে এমন অনেক আলোচনাই আছে। তবে সেগুলো আইনের আলোকে ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ভিসিকে চিঠি দিয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল। সে কারণে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু থেকেই ত্রুটিপূর্ণ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক এক সদস্য বলেন, এসব কথা তিনি (ভিসি) এখন আলোচনা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি যদি এতোই আইন মানবেন, তাহলে তো তার কাছে উল্টো প্রশ্ন করতে হয় যে, ২০০৯ সালে যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডহক নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিলো, সেটা তিনি অমান্য করলেন কেন? প্রজ্ঞাপণ কি অমান্য করার জন্য?

অধ্যাপক সোবহান ‘সৎ ভাবে’ বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করেননি বলে দাবি করে সাবেক ওই শিক্ষক বলেন, তিনি (ভিসি) এখন আইনের দোহাই দিচ্ছেন, ভালো কথা। কিন্তু তিনি কেন রেজিস্ট্রার থাকার পরেও তাকে নাই দেখিয়ে তার অনুগত একজনকে দিয়ে স্বাক্ষর করালেন? তিনি ১২(৫) পড়েছেন, কিন্ত ১২(১০) কি পড়েননি? এখানে তো রেজিস্ট্রার রাজি না, আর ভিসি সেটা করতে চান। আর অধ্যাদেশের ওই ধারায় তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিসি দ্বিমত করলে কী করণীয়, তা স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট নাজিম মৃধা রাজটাইমসকে বলেন, উপাচার্য যদি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে নিজ ক্ষমতায় এডহক নিয়োগ দেন বিজ্ঞপ্তিকে বাইপাস ক'রে তাহলে আইনের দৃষ্টিতে এডহক নিয়োগ দ্বারা বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীদের আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

যদি এমনটি হয়ে থাকে এডহক নিয়োগ অবৈধ বলে গণ্য হবে যদি আবেদনকারী কেউ তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা তো রয়েছেই।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মাহফুজ বিন ইউসুফ রাজটাইমসকে বলেন, ভিসির অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়োগ দানের নির্বাহী ক্ষমতা থাকলেও যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পূর্ব থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল সুতরাং নিয়োগটি অবৈধই হবে।

  • এসএইচ


বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top