রাসিকের সাবেক মেয়র লিটনের টাকা কামাইয়ের মেশিন ছিল নগরভবন

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩০; আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:৪৯

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ফাইল ছবি

সোয়া ২ কোটি টাকা মূল্যের ফ্লাডলাইট স্থাপনে ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি টাকা। এভাবে অতিরিক্ত দর দেখিয়ে এবং নানা প্রকল্প তৈরি করে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) বরখাস্তকৃত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে। খবর দৈনিক আমাদরে সময়ের ।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ২০১৮ সালে রাসিকের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নগর ভবনকে রীতিমতো টাকা কামাইয়ের মেশিন বানিয়েছিলেন তিনি। এ জন্য ঠিকাদারদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পছন্দের ঠিকাদারদের যোগসাজশে তিনি অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্প গ্রহণ করেন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইজিপি টেন্ডার হলেও লিটনের ইশারায় কোড পেয়ে যেতেন পছন্দের ঠিকাদাররা। এমন কী, বিদেশ ভ্রমণেও লিটন ঠিকাদারদের সঙ্গে যেতেন। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, প্রভাব খাটিয়ে রাজশাহী ওয়াসা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুয়েটের ঠিকাদারি কাজও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রাজশাহী বিভাগীয় সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, নগর ভবনকেন্দ্রিক যেসব টেন্ডার হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার। বিশেষ করে টেন্ডার প্রক্রিয়াগুলো পদ্ধতিগতভাবে সঠিক ছিল না কিনা, নিয়ম মেনে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বার বার কাজ পেয়েছে কিনা, অনিয়ম হয়েছে কি না- এসব বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত।

হ্যারোর দাপটে অসহায় সবাই : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে রাজশাহী মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি মোড়ে ১৬টি হাইমাস্ট পোল ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হয়। ফ্লাডলাইট স্থাপন এবং সহায়ক উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়া ২ কোটি টাকা হলেও রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করে। অর্থাৎ, ঠিকাদারকে বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩ টাকার বেশি বিল পরিশোধ করা হয়। এই লক্ষ্যে আগেই আশরাফুল হুদা টিটুর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটির হিসাব মতো দরপত্র আহ্বান করা হয়।

জানা গেছে, চীনের তৈরি ২০ থেকে ২৫ মিটার উচ্চতার একটি হাইমাস্ট পোল বা খুঁটির সর্বোচ্চ দাম তিন হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা হয়। এর সঙ্গে ৬১ শতাংশ হিসাবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ টাকা আমদানি শুল্ক, ক্রয়মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ হিসাবে ৪৩ হাজার ২০০ টাকা ভ্যাট ও আয়কর, বন্দর থেকে দেশের যে কোনো স্থানে সর্বোচ্চ পরিবহন ও স্থাপন ব্যয় ৭০ হাজার টাকা এবং প্রচলিত নিয়মে ১৫ শতাংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করলে একেকটি ফ্লাডলাইট পুলের খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি খুঁটির জন্য হ্যারোকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেছে। প্রতিটি খুঁটিতে অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা করে।

ফ্লাডলাইট পুলে ব্যবহৃত ২০০ ওয়াট ক্ষমতার ৩২০টি এলইডি লাইটের প্রতিটির বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা হলেও টেন্ডারে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা দর ধরা হয়। সে হিসাবে মোট ২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়। ২০০ ওয়াটের প্রতিটি এলইডির দাম ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা করে মোট ২ কোটি ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। অথচ বাজারমূল্যে ৩২০টি এলইডির মোট দাম পড়ে ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬০ টাকা। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪০ টাকা পরিশোধ করা হয়। ফ্লাডলাইটে সংযোজিত ২০০টি ২৫০ ওয়াট ক্ষমতার এলইডির প্রতিটির বাজারমূল্য ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা হলেও টেন্ডারে প্রতিটির মূল্য ৭৫ হাজার টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়।

চীনা আরওএইচএস কোম্পানির তৈরি ২০০টি এলইডির মোট বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৮০৪ টাকা। কিন্তু হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংকে অতিরিক্ত ১ কোটি ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকাসহ এই খাতে মোট বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। ৬৩ এএমলি অটো লজিক কন্ট্রোলারের এক ইউনিটের বাজারমূল্য ৩৬ হাজার টাকা হলেও ঠিকাদারকে ১৬টি এএমপি কন্ট্রোলারের প্রতি এককের মূল্য ৭২ হাজার টাকা হিসাবে মোট ১১ লাখ ১৫২ হাজার টাকার বিল দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হ্যারোকে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে ১ হাজার ২৪০ মিটার ক্যাবল সরবরাহেও ঠিকাদারকে ৩৭ হাজার ২০০ টাকা বেশি বিল দিয়েছে রাসিক।

ওই সময় এই ঘটনা জানাজানি হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে একটি টিম নগর ভবনে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জব্দ করে। এরপর রহস্যজনকভাবে বিষয়টি দুদকে চাপা পড়ে যায়।

এদিকে, নগরীর বিলশিমলা থেকে কাশিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়কবাতি বসানোর কাজটি পায় হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং। ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে চার লেন সড়কটির আইল্যান্ডে চীন থেকে আনা সড়কবাতির ১৭৪টি খুঁটি স্থাপন করা হয়। তবে উদ্বোধনের কিছুদিন পর ওই বছরের এপ্রিলে ধূলিঝড়ে ৮৬টি খুঁটি উপড়ে পড়ে। হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এ প্রকল্পেও মেয়র লিটন মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রিথিনের কারিশমা : রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রায় সব ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন রিথিন এন্টারপ্রাইজের মালিক তৌরিদ আল মাসুদ রনি। তিনি মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। শুধুমাত্র অঢেল টাকা আর লিটন পরিবারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কারণে তার একছত্র প্রভাব ছিল। গত কয়েক বছর সিটি করপোরেশনে একাই কয়েকশ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন রনি। লিটন পরিবারের প্রভাবের কারণে বিভিন্ন কমিটিতেও রনিকে রাখা হয়েছিল। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ছিলেন লিটনের কোটায়। জেলা ক্রীড়া সংস্থায়ও ছিলেন তিনি।

আবার লিস্টেড ঠিকাদার হওয়ার পরও রাজশাহী ওয়াসার পরিচালনা বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল তৌরিদ আল মাসুদ রনিকে। লিটনপত্নী শাহিন আকতার রেনী ওই বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। নিয়ম ভঙ্গ করে রনিকে ওয়াসার বোর্ড মেম্বার করায় সেখানকার ঠিকাদারি কাজও নিয়ন্ত্রণ করা সুবিধা হয়। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিয়াপাড়া পাবলিক লাইব্রেরির পুরনো ভবন ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়েছিল এই রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজকে। বরাদ্দের সব টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভবনটির পাইলিংয়েই খরচ দেখিয়ে দেয়। লিটন পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এ নিয়ে আরো কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। লিটনের আশির্বাদে পার পেয়ে যান রনি।

লিটনের আমন্ত্রণেই মজিদ অ্যান্ড সন্সের থাবা : রূপপুরের বালিশকা-ে বিতর্কিত ‘মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্র্রাকশন’ রাজশাহী মহানগরীতেই প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ পায়। এর মধ্যে রাসিকের ১ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ রয়েছে। তৎকালীন মেয়র লিটনের হাত ধরেই রাজশাহীতে থাবা বসায় মজিদ অ্যান্ড সন্স। বিনিময়ে লিটনকে ‘খুশি রাখত’ দেশের আলোচিত এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় রাসিকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদিত হয়।

প্রকল্পের ১০৭ ধরনের কাজের মধ্যে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ রয়েছে। একই বছর ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। ২০২২ সালে নকশা চূড়ান্ত ও দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে ২০২৩ সালে নগরীর বর্ণালী মোড়, বন্ধগেট ও বিলিসিমলা রেলক্রসিংয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার ২৫৫ মিটার ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ পায় আলোচিত মজিদ সন্স। সম্প্রতি ৭৯ কোটি টাকার এই ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। লিটনের চাপে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও রাজশাহী ওয়াসার কাজও পায় মজিদ সন্স।

উল্লেখ্য, গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরই রাসিক মেয়র লিটনও নগর ভবন থেকে পালিয়েছেন। সেই সঙ্গে আলোচিত ঠিকাদাররাও গা-ঢাকা দিয়েছেন।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top