পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে One Health Approach-এর প্রয়োজনীয়তা

মোঃ রোকনুজ্জামান | প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:৫৩; আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ০৯:৪৬

ছবি: সংগৃহীত

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং নানা প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ক্রমাগত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে, যা মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও জীবনমানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

প্রযুক্তির উন্নয়ন একদিকে যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, অন্যদিকে পরিবর্তনশীল পরিবেশ মানুষ ও প্রাণীস্বাস্থ্যের জন্য নতুন নতুন হুমকি তৈরি করছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের দেখিয়েছে যে মানবস্বাস্থ্য, প্রাণীস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ পরস্পরের সাথে কতটা গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে দুঃখজনকভাবে, বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনো পৃথক ও খণ্ডিত নীতির ওপর নির্ভরশীল। মানবচিকিৎসা, প্রাণীচিকিৎসা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এখনো পৃথকভাবে পরিচালিত হয়, যা আধুনিক স্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকর নয়।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য One Health Approach একটি সময়োপযোগী ও টেকসই সমাধান হতে পারে।এটি এমন একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একসঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। ২১ শতকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে One Health Approach কেবলমাত্র একটি বিকল্প নয়, বরং সুস্থ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ।

ওয়ান হেলথ কী? কেন ওয়ান হেলথ এত বেশি তাৎপর্যপূর্ণ?

University of California,Davis এর মতে, ওয়ান হেলথ (One health) বলতে মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত সমস্যা সমাধানের একটি পদ্ধতি,যা স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ ওয়ান হেলথ বলতে বুঝায়, এমন একটি সমন্বিত বহুমুখী ও আন্তবিভাগীয় রূপরেখা,যা মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও তাদের পৃথক পরিবেশের মধ্যকার যে আন্তসম্পর্ক তা বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। "One health "শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ২০০৩-০৪ সালে, যখন Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) বিস্তৃতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে আরো উচ্চমাত্রার সংক্রামক হিসেবে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (H5N1) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তা ছাড়া ২০০৪ সালে Wildlife Conservation Society এর উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে "Manhattan Principles" ঘোষিত হয়, যেখানে মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং রোগের বিস্তার খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ তা স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমান এই শতাব্দীতে ক্রমাগত ভাবে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট পরিবর্তন সংঘঠিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের সাথে সাথে" One Health Approach "বিষয়টি ও ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। ওয়ান হেলথ দৃষ্টিভঙ্গি এতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠার কারণ হল ইহা মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের জটিল আন্ত:সম্পর্ককে তুলে ধরে, আন্তবিভাগীয় সহযোগিতা কে উৎসাহিত করে।"One Health Approach" এর এই সমন্বিত ব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ গুলোর পূর্বাভাস, প্রতিরোধ এবং মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়,যা One health এর তিনটি ক্ষেত্রের যথা মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের সংযোগস্থলে উৎপত্তি হয়।

যেমন নতুন উদ্ভাবিত অনেক সংক্রামক রোগ জুনোটিক রোগ, অর্থাৎ যেই রোগ গুলো প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে,সেসব রোগের কার্যকর মোকাবিলার জন্য এগুলোর সংক্রমণগত গতিশীলতা সম্পর্কে একটি সামগ্রিক বোঝাপড়া প্রয়োজন হয়,যা শুধুমাত্র One Health Approach এর মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়াও One Health Approach বর্তমান সময়ে উদ্ভূত অন্যতম স্বাস্থ্যঝুঁকি তথা Antimicrobial Resistance (AMR) মোকাবেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Antimicrobial Resistance বর্তমান সময়ের আলোচিত এক অন্যতম স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে যা এক ক্ষেত্র থেকে অন্য ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করতে পারে।তাই উদ্ভূত এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ কে মোকাবেলা করতে হলে আমাদের একটি সমন্বিত, বহুমুখী ও কার্যকর কৌশল প্রয়োজন যেখানে মানুষ ও প্রাণীর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক এর নিরাপদ ব্যবহার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

তাছাড়া ওয়ান হেলথ যুগোপযোগী ও টেকসই পদ্ধতির বিস্তৃতি ঘটায় যা খাদ্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য ব্যাপক কার্যকরী বলে প্রতীয়মান। বিগত সময়ের অধিকাংশ নতুন ও উদীয়মান সংক্রামক ও জুনোটিক রোগ প্রাণী থেকে বিশেষ করে বন্যপ্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এইসব জুনোটিক রোগের বিস্তারের প্রধান কারণ সমূহ মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ এর সাথে সম্পৃক্ত। যার মধ্যে রয়েছে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। সুতরাং এসব রোগের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে একটি টেকসই ও নিরাপদ বাসস্থান করতে প্রাণী, মানুষ ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত ভাবে কাজ করা প্রয়োজন যা One Health Approach কে সংজ্ঞায়িত করে।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ওয়ান হেলথ দৃষ্টিভঙ্গির কার্যকারিতা:

বর্তমান সময়ের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ওয়ান হেলথের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং মানুষ ও প্রাণীর ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ নতুন নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বহুগুণে বৃদ্ধি করছে। ফলে মানব স্বাস্থ্য, প্রাণী স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের মধ্যে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তথা One Health Approach গ্রহণ করা একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ মহামারী আমাদেরকে দেখায় যে শুধুমাত্র একক নীতির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য কে অটুট রাখা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা তথা সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে বন্যপ্রাণী, গৃহপালিত প্রাণী এবং পরিবেশের স্বাস্থ্যের উপর।তাই বর্তমান সময়ের আলোচিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় ওয়ান হেলথ বাস্তবায়ন এখন খুবই দরকারী। যেমন:

১.Anti microbial Resistance (AMR) মোকাবেলায় ওয়ান হেলথ: এন্টিবায়োটিক এর অতিরিক্ত ও অসচেতন ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়া গুলো ধীরে ধীরে ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে,ফলে এই পরিস্থিতি মানুষ ও প্রাণীর চিকিৎসাকে আরো জটিল করে তুলছে।তাই AMR মোকাবেলায় মানব, প্রাণী এবং পরিবেশের সাথে একীভূত হয়ে কাজ করা ছাড়া বিকল্প নাই যা ওয়ান হেলথ পদ্ধতির মূল লক্ষ্যগুলির একটি।

২. সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধে ওয়ান হেলথ: বিগত বছরগুলোতে ছড়িয়ে পড়া বেশিরভাগ নতুন সংক্রামক রোগ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। যেমন:কোভিড-১৯, ইবোলা ভাইরাস,জিকা ভাইরাস ইত্যাদি।এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৭৫% নতুন সংক্রামক রোগ প্রাণী থেকে ছড়ায়। সুতরাং এসব রোগের কার্যকর প্রতিরোধ, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ওয়ান হেলথ পদ্ধতি অতীব প্রয়োজনীয়।

৩.খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওয়ান হেলথ: প্রাণী স্বাস্থ্য এবং খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ওয়ান হেলথ বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

৪.বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধে ওয়ান হেলথ: সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া করোনা মহামারী বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে যে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংকট নিরসনে সমন্বিত ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। মহামারীর বিস্তার রোধে শুধুমাত্র মানব স্বাস্থ্য নয়,বরং প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ান হেলথ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটা কার্যকর কাঠামো প্রদান করে।

সুতরাং, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বকে আগামীতে সুন্দর নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো মজবুত করা প্রয়োজন। এজন্য ওয়ান হেলথ একটি যুগোপযোগী, সমন্বিত ও কার্যকর স্বাস্থ্য রক্ষা কৌশল হতে পারে,যা মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একত্রে বিবেচনা করে একটি শক্তিশালী ও মজবুত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষক ও সদস্য - এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top