সেই রাতে তালা ঝুলে দুই টিভিতে, বেকার হন হাজারো কর্মী

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৫ মে ২০২৫ ১২:৪৪; আপডেট: ৫ মে ২০২৫ ১৭:৫৬

ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলের একটি অন্যতম কালো অধ্যায় ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে। এদিন দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে একটি আলোচিত ও বিতর্কিত অধ্যায় রচিত হয়। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে সরকার হঠাৎ করেই দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল—দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। এতে বেকার হন দুই টেলিভিশনের হাজারো কর্মী। পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদের চোখ রাঙানিতে তাদের অনেকেই ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেননি। খবর ঢাকা মেইলের ।

হেফাজতের ওই সমাবেশে সহিংসতা শুরু হলে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সরাসরি সম্প্রচার করছিল। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ তুলে ধরছিল। যা তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের মতে ‘উসকানিমূলক’ এবং ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করে, এই দুটি চ্যানেল নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা না দেখিয়ে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করছিল, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। বিশেষ করে নিহতের সংখ্যা ও আন্দোলন পরিস্থিতি প্রচার করা হয়, যা সরকারের জন্য আতঙ্কের ছিল।

সরকারের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ওই রাতেই ইসলামিক টিভি এবং ভোরে দিগন্ত টিভির সম্প্রচার সাময়িকভাবে স্থগিত করে। চ্যানেলগুলোর অফিসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়।

দিগন্ত টিভির বার্তা সম্পাদক জিয়াউল কবির সুমনের ভাষ্যমতে, প্রায় রাত ৩টার দিকে বিটিআরসির পরিচালক সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এসে টেলিভিশনের প্রধান সম্প্রচার কক্ষ, মাস্টার কন্ট্রোল রুম সিলগালা করে দেয় এবং সরঞ্জাম জব্দ করে। একইভাবে ইসলামিক টিভির কার্যালয়েও পুলিশ অভিযান চালিয়ে সম্প্রচারের সব ধরনের যন্ত্রাংশ বন্ধ করে দেয়।

ইসলামিক টিভির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, রাতের আঁধারে একদল পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা অফিসে প্রবেশ করে। তারা ভেতরের যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক ভাঙচুর করে এবং কর্মীদের হেনস্তা করে। এতে সংবাদ পরিবেশনের সকল কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

চ্যানেল দুটি তখন বলেছিল, তারা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ায়নি এবং যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তবে সেটি অনিচ্ছাকৃত। যদিও দিগন্ত টেলিভিশন সরকারকে পাঠানো জবাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে আরও সতর্কতার সঙ্গে সম্প্রচার চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে সরকারের এই পদক্ষেপ গণমাধ্যম জগতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দেশের ১৫টি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, এটি ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এক অশনি সংকেত। তারা দাবি করেন, চ্যানেল দুটি ভুল করলেও সেটার বিচার সংবিধানসম্মত উপায়ে করা উচিত ছিল, এইভাবে হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ করা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী।

দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ হওয়ার পর থেকে এই বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন, যা থেকে বোঝা যায় এই সিদ্ধান্ত অনেকের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে চ্যানেল দুটি খুলে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর চ্যানেল দুটি বন্ধই থাকে। তারা একাধিকবার সম্প্রচার চালুর আবেদন করলেও তা কার্যকর হয়নি। অবশেষে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দিগন্ত টেলিভিশনের ওপর আরোপিত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তে চ্যানেলটি আবার সম্প্রচারের সুযোগ পায়। ইসলামিক টিভির বিষয়েও আলোচনা চলমান রয়েছে। যদিও এভাবে বন্ধ করে দেওয়ায় দুটি টেলিভিশনে শত শত কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।

এই পুরো ঘটনাটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে একটি বিতর্কিত এবং শিক্ষনীয় অধ্যায় হয়ে আছে। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি এটি সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক, মতপ্রকাশের পরিসীমা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব—সবকিছুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে ওঠে।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top