ঐতিহাসিক সিনেমা
হোটেল রুয়ান্ডা
লাবণ্য শাহিদা | প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারী ২০২১ ২১:১২; আপডেট: ৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:২৬
Hotel Rwanda (2004)
Genre:Drama/Historical drama
IMDB:8.1 Rotten Tomatoes:91%
'এই মানুষে মানুষ গাথা, গাছে যেমন আলকলতা। জেনে শুনে মুড়াও মাথা, জাতে ত্বরবি' কথাগুলো লালনের গানের। এখন ভাবলে মনে হয় আমাদের এই পৃথিবীর একটা অংশ শুধু জাতিগত সংঘাতেই কেটে গেল। বিশেষ করে আফ্রিকা অঞ্চলে, যেখানে জাতিগত বিচিত্রতা ভরপুর। আর তার মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা উল্লেখযোগ্য ।
একটু রুয়ান্ডার ইতিহাস নিয়ে বলি। রুয়ান্ডার জনগণের মধ্যে মূল দুই গোষ্ঠী হচ্ছে হুতু ও তুতসি, যার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হুতু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা দখলে নেয় বেলজিয়াম। তারা রুয়ান্ডার ক্ষমতায় বসায় তুতসিদের। দেশটার ব্যবসা-বাণিজ্য এই তুতসিরা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৬২ সালে রুয়ান্ডা ছেড়ে চলে যায় বেলজিয়াম। এরপর তুতসিদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের কাছে। ক্ষমতার পালাবদলে জমানো ক্ষোভ গণহত্যার রূপ নেয়। আর এই দুই জাতির বিদ্বেষকে কেন্দ্র করে নৃশংস গণহত্যার উপর ভিত্তি করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘হোটেল রুয়ান্ডা’ (২০০৪) মুভিটি।
মুভির প্রধান চরিত্র পল রোসেসবেগিনা, যিনি হোটেল মি' কোলিনে কর্মরত, জাতিতে একজন হুতু, যার আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট প্রখর। সরকারের সব উচ্চপদস্থ এবং হোটেলে আগত বলেন বিদেশী গেস্টদের আপ্যায়নের জাদুতে বিমোহিত করে রাখে। যিনি হুতু মিলেশিয়া প্রধান ‘জর্জ রুতুগুনডু’ ও সেনাবাহিনীর প্রধান ‘জেনারেল বিজিমুঙ্গু’র সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রেখে সাবধানে চলাফেরা করেন। জীবনে ভালবেসে বিয়ে করে তুতসি তাসিয়ানাকে, যাদের তিন সন্তানের সুখি পরিবার। কিন্তু পরিস্থিতি আর সুখের থাকলো না। শুরুতেই আমরা দেখতে পায় হুতু নিয়ন্ত্রিত রেডিও 'আরটিএলএম' তুতসিদের নিয়ে বিষাদগার করতে থাকে, তাতে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু প্রেসিডেন্টের হত্যাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। হুতুদের পক্ষ থেকে তুতসিদের দোষারোপ করা হয় এক পর্যায়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় তুতসিদের উপরে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় পল তার পরিবার আর প্রতিবেশী সহ সবাইকে নিয়ে চলে আসে হোটেল মি'কোলিনে। হোটেল মি’কোলিন হুতু আক্রমন থেকে কিছুটা নিরাপদ কারন হুতুরা জানে হোটেলটিতে বিদেশী সাংবাদিক ও ইউএন অফিশিয়ালরা অবস্থান করছে। কিন্তু একসময় দেখা যায় রেডক্রস, চার্চ থেকে শুরু করে পুরো হোটেল জুড়েই রিফিউজিদের সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ১২৬৮! কিন্তু পরিস্থিতির আরো নির্মমতা ফুটে উঠে যখন হোটেল থেকে শুধুমাত্র বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে যাওয়া হয় সেইফজোনে, দিন শেষে যেন সেই চিরচেনা রূপে আবার নিয়তির কথা, সাদা চামড়ার মানুষদের কাছে কালো চামড়ার মানুষের জীবনের কোন দাম নেই। স্বার্থবাদী আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের নীরব ভূমিকার বর্হিপ্রকাশ চোখে পড়ার মত। এক হাজার তুতসি-হুটু শরণার্থীদের নিয়ে হোটেল নামক নরকে পল রুসেসাবাগিনা ও তার পরিবার মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে আর শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। মুভির প্রতিটি দিন যেন একটি নতুন জীবনের জন্ম দেয়, সাসপেন্স আর থ্রিলিংয়ে ভরপুর। একটা গণহত্যায় সবচেয়ে বেশি ভিকটিম নারী আর শিশু পরিচালক যেন আবারো তাই একবার বলে গেল এ মুভিতে। একটা দৃশ্যে পল আর ড্রাইভার যখন খাবার আর রসদ সংগ্রহ করার জন্য হুতু মিলেশিয়া প্রধান জর্জ রুতুগুনডুর কাছে পৌছায়, সেখানে তুতসি নারীদের দলবদ্ধকরে ধর্ষনের পর হত্যার দৃশ্যটি গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত ছিল। এরপর খাবার নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় লাখ লাখ লাশের স্তুপে তাদের গাড়ির চাকা আটকে থাকা মিনিটে মিনিটে নার্ভকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল! এসব দৃশ্য আমাদের নিজেদের নিকট অতীতের ইতিহাস যেন আরো একবার মনে করিয়ে দেয়। মুভির পরিচালক টেরি জর্জ দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে নির্মাণশৈলিতে। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছিল ১৯৯৪ সালের সেই এপ্লিল-জুনেতে আছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও দক্ষিণ আফ্রিকার যৌথ প্রযোজনায় হোটেল রুয়ান্ডা মুভিটি পরিচালনা করেছেন এই উত্তর আয়ারল্যান্ডীয় পরিচালক। অস্কারের তিনটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পাওয়া এবং আইএমডিবিতে ৮.১ রেটিং পাওয়া এ মুভিটি আপনার আড্রিনাল গ্রন্থিকে বারবার উত্তেজিত করবে। ‘পল রুসেসাবাগিনা’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডন চেডেল আর তাসিয়ানার চরিত্রে সোফি ওকোনেডো যথার্থই অভিনয় করেছে। বেঁচে থাকার আকুতি আর মৃত্যুর দুয়ারে হাজির হওয়ার বেদনা পুরো মুভির প্রাণ। একটি দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। আমাদের ড্রয়িংরুম সোসাইটির প্রতিক্রিয়া জেনোসাইড নিয়ে কতটা প্রহসনমুলক হতে পারে তা বর্ননা করতে গিয়ে মুভির একটি দৃশ্যে এক সাংবাদিকের মুখে যখন শোনা যায় - “If people see this footage, they'll say, 'Oh my God, that's terrible,' and they'll go on eating their dinners.” উক্তিটি করা সাংবাদিকের ভুমিকায় যিনি রয়েছেন এ মুভিতে, এ বছরটা শুধুমাত্র তাকে ঘিরেই আলোকিত হয়ে ছিল আর মাথায় নিয়েছে সেরার মুকুট, তাই তাকে নিয়ে রহস্য রেখে গেলাম!
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: