রাত পোহালেই ভোট উৎসব, আছে শঙ্কার কালো মেঘও
রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ৬ জানুয়ারী ২০২৪ ২২:৫৭; আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০৩

রাত পোহালেই দেশজুড়ে ভোট উৎসব। একযোগে দেশের ২৯৯টি আসনে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে ভোটের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রে কেন্দ্রে চলে গেছে ভোটের সরঞ্জাম। কিছু কেন্দ্রে রাতেই পাঠানো হচ্ছে ব্যালট পেপার। তবে বেশির ভাগ কেন্দ্রে যাবে সকালে।
প্রতি পাঁচ বছর পর দেশে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। ভোট মানেই উৎসব। জনগণ সুযোগ পান তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেওয়ার। এবারের ভোটে উৎসব থাকলেও পাশাপাশি বিরাজ করছে শঙ্কার কালো মেঘও। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল নির্বাচনে আসেনি। ভোট বর্জন করে তারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এতে ভোটের আগ মুহূর্তে দেশজুড়ে নাশকতার ঘটনায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে জনমনে। ভোট উৎসবে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করাই এবারের নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকার ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। এ ব্যাপারে বেশ তৎপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি সবাইকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালনে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় জানিয়ে সিইসি বলেছেন, বিশৃঙ্খলা করলে বন্ধ হতে পারে ভোট, বাতিল হতে পারে প্রার্থিতা। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরপেক্ষভাবে ভোট গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোটগ্রহণ চলবে। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম মারা যাওয়ায় ওই আসনের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। ফলে আগামীকাল ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীও।
ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন
সারাদেশে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সারাদেশে মোট ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ দুই লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ছয় কোটি ৭৬ লাখ নয় হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন।
এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের দুই হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হবে ভোটের আগের দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে চার লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হবে।
নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দুজন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দুজন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ জন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে।
নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটর সাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ইসির স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কতিপয় যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ক্যাব, পিক আপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক।
দেশজুড়ে নাশকতা, শঙ্কা ভোটের দিন নিয়ে
২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো এবারও দেশজুড়ে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। শুক্রবার রাতে ঢাকায় একটি ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে মারা গেছেন চারজন। এছাড়া পিরোজপুরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
একইসঙ্গে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্পে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হামলার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পটিয়া ও আগ্রাবাদে ক্যাম্প ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে এবং এ ঘটনায় থানায় জিডি হওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা। এর বাইরে ফেনী, রাজশাহী ও নোয়াখালীতে ভোট কেন্দ্র ও কিছু প্রার্থীর ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কক্সবাজারের রামুতে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের কাঠের সিঁড়িতে শুক্রবার রাতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মিডিয়া সেল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, শুক্রবার ও আজ শনিবার বিএনপি-জামায়াত দেশের ২০টিরও বেশি ভোটকেন্দ্রে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। রাজবাড়ীর একটি স্কুলে পাহারায় থাকা গ্রাম পুলিশের এক সদস্যকেও তারা হত্যা করেছে। রামুতে রাখাইন মন্দিরে আগুন দিয়েছে। ডেমরা ও কুমিল্লায় দুইটি বাসে আগুন দিয়েছে তারা। ভোলাতে বেসরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর ও হামলা করেছে। এই চিত্র শুধু গত দুই দিনের।
এদিকে ভোটের রাত এবং ভোটের দিন নাশকতা ও সহিংতার ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর ডাকা আন্দোলনের নাশকতা অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে নৌকার প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ভোটগ্রহণ নির্বিঘ্নভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন তারা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: