দেড় যুগে দেশছাড়া বিএনপির ৫ শতাধিক পদধারী নেতা
রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৮ জুন ২০২৪ ১০:১৮; আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ২০:১৭
-2024-06-28-10-17-37.jpg) 
                                নানা কারণে গত প্রায় ১৮ বছরে বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী ৫ শতাধিক নেতা। তাদের মধ্যে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন দল ও অঙ্গসংগঠনের সম্ভাবনাময় তরুণরা। এই তালিকায় থাকা নেতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকের নামে জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
আবার বিদেশে বসবাস করলেও অনেকের নামে নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। অনেক মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফলে বিদেশে থাকা নেতাদের কেউ দেশে ফিরলে নিশ্চিতভাবেই কারাগার হবে তাদের ঠিকানা। এ কারণে বেশিরভাগ নেতাই আপাতত দেশে ফেরার চিন্তা করছেন না বলে জানা গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বিএনপি নেতা ও তাদের স্বজনদের দাবি, ওয়ান-ইলেভেন ও বর্তমান সরকারের দেড় যুগে রাজনৈতিক মামলা, হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ জানান, রাজনৈতিক কারণে শেষ বয়সে এসে কারাগারে যেতে হবে—এমন আতঙ্কেও রয়েছেন তারা। অবশ্য দেশে ফেরার অপেক্ষাও করছেন কেউ কেউ। দেশের মাটিতেই যেন মৃত্যু ও শেষ ঠিকানা হয়—এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে যোগাযোগ করে বিদেশে বসবাসরত নেতাকর্মীদের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতার সংখ্যা ৫শর বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আর বিদেশে চলে যাওয়া কর্মী-সমর্থকের সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন ও মামলার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। তবে সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের প্রতিনিয়ত সরকারের চাপ, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে থাকতে হয়। মিথ্যা মামলায় সাজা এবং ভবিষ্যতে সরকারের আরও রোষানলে পড়ার শঙ্কায় অনেকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।’
দেশ ত্যাগ করা কয়েকজন নেতা জানান, বিদেশে থাকা অবস্থায়ও তাদের মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলায় আসামি করা হয়েছে। দেশে ফিরতে না পারায় তারা আইনগতভাবে মামলা মোকাবিলাও করতে পারছেন না। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিএনপি নেতা মঞ্জুর হাসান পল্টুর পরিবারের সদস্যরা জানান, ১০ বছরের বেশি সময় লন্ডনে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন লোকজন প্রায়ই পল্টুর খোঁজে গ্রামের বাড়িতে আসেন।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করতেই বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে চাইছে। সেজন্য নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা চলছে। অনেক নেতাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আবার কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিলে তিনি মামলামুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর এর উদাহরণ। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া মাত্রই তার নামে কোনো মামলা নেই, সহজেই এমপি নির্বাচিত হলেন। অথচ একই মামলায় আসামি হয়ে সিনিয়র অনেক নেতাকে জেল খাটতে হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে প্রায় ৫০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধেও দুদকের মামলায় তিন বছরের সাজা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। সেখান থেকেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিএনপির এই শীর্ষ নেতা ও তার স্ত্রী সহসাই দেশে ফিরতে পারছেন না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও ৯টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে একটি মামলায় ৯ বছরের সাজা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ প্রায় ৯ বছর ধরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে অবস্থান করছেন। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে তিনি নিখোঁজ হন। ৬২ দিন পর ১১ মে তাকে উদ্ধার করে শিলংয়ের পুলিশ। পরে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে সেদেশে মামলা হয়। ওই মামলায় সালাউদ্দিন আহমেদ ২০১৮ সালে খালাস পান। ২০২৩ সালে আপিলেও তিনি খালাস পান। এরপর ১৫ মাস পার হলেও ট্রাভেল পাস না দেওয়ায় দেশে ফিরতে পারছেন না তিনি।
জানা গেছে, বিদেশে অবস্থান করলেও ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন ফোরামের বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন এই দুই নেতা। দলীয় সিদ্ধান্তেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই। দলীয়করণের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। যে অপরাধ করিনি, সেই মামলায় আমাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজদের না ধরে বিএনপি নেতাদের ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘নিজ দেশ ছেড়ে কেউ শখের বশে বিদেশে থাকে না। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায় নির্যাতন-নিপীড়নে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী বিদেশে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাকে কীভাবে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে, এটা দেশবাসী জানে। আমি অসুস্থ, আমার বয়স হয়েছে। বাংলাদেশে আমার মৃত্যু হোক—এটাই আমার শেষ চাওয়া।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমার বিরুদ্ধে মামলা নেই, আদালত খালাস দিয়েছেন। তার পরও দেশে ফিরতে পারছি না।’
অন্যদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. ওসমান ফারুক ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক বেবি নাজনীন, নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল লতিফ সম্রাট ও জিল্লুর রহমান জিল্লু। মালয়েশিয়ায় আছেন ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, ক্ষুদ্র ঋণবিষয়ক সম্পাদক এমএ কাইয়ুম এবং তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান (এ্যাপোলো)। যুক্তরাজ্যে আছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাহিদুর রহমান, কয়ছর এম আহমেদ, এমএ মালিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন, হুমায়ুন কবির, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ও সুজাত মিয়া।
নির্বাহী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন, মির্জা খোকন এবং সাহাবুদ্দিন লাল্টু ও ফয়সাল আহমেদ কানাডায় রয়েছেন। বেলজিয়ামে আছেন সাইদুর রহমান লিটন, সুইডেনে আছেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজমুল আবেদিন মোহন। এর বাইরেও বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা বিভিন্ন দেশে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রায় ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়া আছেন বিএনপির ক্ষুদ্র ঋণবিষয়ক সম্পাদক এম এ কাইয়ুম। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সঠিক সংখ্যা তিনি নিজেও জানেন না। ইতোমধ্যে কয়েকটি মামলায় তার সাজাও হয়েছে।
এম এ কাইয়ুম বলেন, ‘মামলা-মোকদ্দমার কারণে বিদেশে চলে এলাম। কিন্তু বিদেশে আসার পরও দেশে আমার নামে মামলা দেওয়া থেমে নেই।’
রাজনৈতিক পেক্ষাপট পরিবর্তন হলেই দেশে ফিরবেন বলে জানান এই নেতা।
তথ্যসূত্র : কালবেলা
বিষয়: বিএনপি

 
                                                    -2020-11-11-19-11-28.jpg) 
                                                     
                                                     
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: