ছয় বছরের সর্বোচ্চে তাপমাত্রা

গাছপালা উজাড়ে চরমভাবাপন্ন রাজশাহীর প্রতিবেশ

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১২; আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:০০

ছবি: বণিক বার্তার

সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে রাজশাহী। প্রশস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, নগরজুড়ে নির্মিত হয়েছে উঁচু উঁচু দালান। অন্যদিকে দখল ও ভরাট হয়েছে বহু জলাধার, উজাড় হয়েছে সবুজ আচ্ছাদন। ফলে চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে এ মহানগরীর পরিবেশ। খবর বণিক বার্তার। 

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বাড়ছে। পুরো শহর এখন তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে।

সর্বশেষ গতকাল রাজশাহীতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর একদিন আগে তাপমাত্রার পারদ চড়েছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্থানীয় আবহাওয়া দপ্তর বলছে, ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড এটি। আর রাজশাহীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ১৯৭২ সালে, ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তবে রেকর্ড তাপমাত্রা যা-ই হোক, রাজশাহীতে এর চেয়েও বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রভাষক মুহাইমিনুল ইসলাম।

এজন্য তিনি দায়ী করেন জলাশয় কমে যাওয়া এবং গাছপালা উজাড় হওয়াকে। তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে এখানে রেকর্ড তাপমাত্রার অন্তত ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। আগামীতে তাপমাত্রার পারদ আরো চড়বে। এ সংকট অপরিকল্পিত ও বাণিজ্যিক নগরায়ণের ফল।’

গত দুই দশকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহার ও ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তনের প্রভাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ তথ্য পান মুহাইমিনুল ইসলামসহ একদল গবেষক। আগামী দুই দশকের তাপমাত্রা কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে সেটির আভাস দিতেই ছিল এ গবেষণা।

২০২০ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ওই গবেষণাপত্র প্রকাশ করে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্সডিরেক্ট’। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নগর এলাকা প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে। তাতে উজাড় হয়েছে ১৯ শতাংশ গাছপালা, জলাশয় ভরাট হয়েছে ৪ শতাংশ। ফলে গত দুই দশকে গড়ে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা কার্বন নিঃসরণের শীর্ষে থাকা অঞ্চলগুলোর চেয়েও বেশি।

মুহাইমিনুল ইসলাম জানান, নগরায়ণের ফলে প্রচুর ভূমি ব্যবহার ও ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তন হয়, যা দ্রুতবর্ধনশীল মেগাশহরগুলোয় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ গবেষণায় তারা নগরায়ণের ফলে ভূমি ব্যবহার ও ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তনের ধরন চিহ্নিত করেন। উপগ্রহের সাহায্যে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে ১৯৯৯, ২০০৯ ও ২০১৯ সালের রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার প্রভাব অনুসন্ধান করেন।

তারা যে ফলাফল পান তাতে দেখা যায়, রাজশাহীতে নগরায়ণের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৯ ও ২০৩৯ সালে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি অনুভূত হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গাছপালা, কৃষিজমি ও জলাশয় রক্ষা করে সিটি করপোরেশন এলাকায় টেকসই নগরায়ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন এ গবেষক।

গবেষকরা আরো বলছেন, শহর উন্নয়নের চালিকাশক্তি। উন্নয়নের পথ নগরায়ণ ত্বরান্বিত করে। আর এ নগরায়ণ শহরের বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য, ভূমিরূপ ও পরিবেশে পরিবর্তন আনে। এর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে।

অন্যদিকে গাছপালা উজাড় করে নগরায়ণ ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কী প্রভাব ফেলছে সেটি নিয়েও আলাদা গবেষণা হয়েছে। ‘সায়েন্সডিরেক্ট’ এ গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ২০২১ সালের আগস্ট সংখ্যায়। সাম্প্রতিক এ গবেষণায় দেখা যায়, রাজশাহী নগর সম্প্রসারণে গত ৩০ বছরে ১৭ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদন হারিয়েছে। এতে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

গবেষণার তথ্যানুসারে, ১৯৯০ সালে ৩ দশমিক ৭৯ বর্গকিলোমিটার জলাশয়, ৭ দশমিক ৩৮ বর্গকিলোমিটার নগর এলাকা, ২৭ দশমিক ১৬ বর্গকিলোমিটার সবুজ আচ্ছাদন (গাছপালা) ও ৯ দশমিক ৭৩ বর্গকিলোমিটার পতিত জমি ছিল। আর ২০২০ সালে এসে রাজশাহী মহানগরে ২ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার জলাশয়, ১৫ দশমিক ৯০ বর্গকিলোমিটার নগর এলাকা, ১৮ দশমিক ৭৭ বর্গকিলোমিটার সবুজ আচ্ছাদন (গাছপালা) ও ১১ দশমিক শূন্য ৭ বর্গকিলোমিটার পতিত জমি। তিন দশকে (১৯৯০ থেকে ২০২০) জলাশয় ৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ও সবুজ আচ্ছাদন ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। নগরায়ণ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

শহরাঞ্চল ও পতিত জমিতে রেকর্ড করা হয়েছে উচ্চতাপমাত্রা। এর উল্টো চিত্র জলাশয় ও গাছপালাবেষ্টিত এলাকায়। এ গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে রাজশাহী শহরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ২০০০ সালে যে এলাকাগুলো ভূপৃষ্ঠের নিম্নতাপ অঞ্চল ছিল, ২০২০ সালে তা উচ্চতাপ অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে।

গাছপালা উজাড় ছাড়াও এ পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও নিকটবর্তী বিস্তীর্ণ শুষ্ক বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রভাবও দায়ী বলে মনে করেন গবেষকরা। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য রাস্তা ও ভবনে প্রাকৃতিক সবুজ আচ্ছাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এ গবেষণায়। একই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণ কমাতে এবং শহরের বর্তমান গাছপালা রক্ষা করার জন্য আইন ও নীতি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে বৃক্ষ রোপণ, অবাষ্পীভবন ও অবাষ্পীভবন বিনির্মাণসামগ্রী পরিবেশবান্ধব দিয়ে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে শহরের সবুজায়ন বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাজশাহী নগরীর প্রায় চার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৭৮টি বড় গাছ উজাড় হয়েছে সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে। এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। অভিযোগ রয়েছে, কোনো ধরনের পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই বহু বছরের পুরনো গাছ সাবাড় করেছে নগর কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে ২০১৪ সালে নগরজুড়ে এক হাজারের বেশি পুকুর ছিল। ৯৩ কিলোমিটার আয়তনের এ শহরে এখন জলাশয় রয়েছে মাত্র ১২০টি। খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী অফিসের পেছনের পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে জমি বিক্রি চলছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ পুকুর ভরাটের পেছনে হাত রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের। আর এ কারণেই নির্লিপ্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

জলাশয়গুলো ভরাটের পর গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। ২০১৭ সালের পর রাজশাহীজুড়ে পাঁচ শতাধিক বহুতল ভবন গড়ে তুলেছে রাজশাহী রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (রেডা)। এর বাইরেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে বহু বহুতল ভবন। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ ভবন নির্মাণেই নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top