অন্ধ মানিক পাশা: মানুষকে সচেতন করাই যার কাজ

আব্দুস সালাম, নাটোর | প্রকাশিত: ৫ জুলাই ২০২১ ০০:৪০; আপডেট: ৫ জুলাই ২০২১ ০১:১২

নাটোরের অন্ধ মানিক পাশা চৌধুরী এভাবেই প্রতিদিন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে হ্যান্ড মাইকে প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

মানিক পাশা চৌধুরী (৪৩)। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন একজন মানুষ। চোখের জ্যোতি না থাকায় সুন্দর এ পৃথিবীর রুপ-রং দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। নিজের চোখে আলো না থাকলেও স্বেচ্ছাশ্রমে দেশের লাখো মানুষকে আলো দেয়ার চেষ্টায় প্রতিদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ান নাটোরের এই অন্ধ হাফেজ। তবে বর্তমানে করোনা মহামারীতে উপার্জনের পথ হারিয়ে বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। মেলেনি সরকারী-বেসরকারী তেমন কোন সহায়তাও। ফলে কখনও খাবার জোটে, কখনও জোটেও না। খাবারের অভাবে তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রায়ই রোজা রাখেন তিনি। এভাবে ক্ষুধার যাতনা সয়েও মানুষকে সচেতন করতে তাঁর প্রতিদিনের প্রচারাভিযান বন্ধ হয়নি একদিনের জন্যও। দারিদ্র পিরীত এ সাদা মনের মানুষটি নাটোর শহরের চক আমহাটি মহল্লার বাসিন্দা।

জানা যায়, শৈশবেই বাবাকে হারানোর পর জেলার নলডাঙ্গা সদরের একটি মাদরাসা থেকে কোরআনের হাফেজ হন তিনি। এরপর ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী মুক ও বধির স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। এসএসসি পাশের পরই ধরতে হয় সংসারের হাল। শুরু করেন স্থানীয় একটি মসজিদে ঈমামতি। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে পালা করে তাকে প্রতিদিন খাবার দিতো। এখানেই বাঁধে সমস্যা। গ্রামের অনেক মানুষ নামাজ পড়ে না, অনেকে আবার সুদে টাকা খাটায়। তাদের বাড়িতেও খেতে হবে এটা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। তিন মাস যেতে না যেতেই তাই তিনি ছেড়ে দেন ইমামতি। বই, খাতা, হরেক রকম কলম, চকলেট, চাবির রিংসহ নানা কিছু কিনে বাসে বাসে ঘুরে বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন রাজশাহী থেকে বগুড়া হয়ে রংপুরে যাতায়াতকারী বাস গুলোতে তিনি এসব সামগ্রী বিক্রি করেন। কেউ কোন কিছু না কিনে টাকা দিলে তিনি কখনো হাতে নেন না। নবম শ্রেণী পড়–য়া ছেলে রাব্বানী, ছোট মেয়ে শরীফা, স্ত্রী আর নিজের বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ভালই কাটছিল তাদের সংসার।

কিন্তু গত বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনার মহামারী শুরু হওয়ার পর কোন বাসে উঠলেই যাত্রীরা আপত্তি শুরু করে। এ রোডের সকল বাসের চালক, সুপারভাইজার ও হেলপার তার চেনা, সবার নামসহ বিস্তারিত মুখস্ত তার, তারা যেন তার অতি আপনজন। তাই চালক, সুপারভাইজার ও হেলপার আপত্তি না করলেও যাত্রীদের আপত্তিতে বন্ধ হয়ে যায় তার উর্পাজনের একমাত্র পথ। জমানো সব টাকা পয়সা দীর্ঘ করোনা কালে সংসারে খরচ হয়ে গেছে। তাই উপার্জনের পথ আর হাতে কোন টাকা না থাকায় পরিবারের সবাই মিলে প্রায়ই উপোষ থাকতে হয় তাদের। খাবারের কষ্টে তাই ছোট মেয়েটি বাদে বাড়ির বাকী চারজনের সবাই দিনের পর দিন রোজা থাকেন। মাসে যে প্রতিবন্ধী ভাতা পান, তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চলে না। করোনা কালে গত দেড় বছরে মাত্র ১০ কেজি চাল ছাড়া কোন সহযোগিতাই পাননি এই জন্ম অন্ধ মানুষটি। তবে এতো কিছুর পরও কারো কাছে হাত পাততে রাজি নন তিনি। যতদিন বেঁচে থাকবেন হালাল উপার্জন করে খেতে চান। চালিয়ে যেতে চান তার সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ড।

তাই মানিক পাশা সিন্ধান্ত নেন, আর বসে থাকা নয়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ছুটে যান নাটোর সদরের ইউএনও জাহাঙ্গীর আলমের কাছে। তার কাছে সব কথা বুঝিয়ে বলে জোগাড় করে ফেলেন একটি হ্যান্ড মাইক। ঘরে বসে নিজের সুন্দর কণ্ঠে রেকর্ড করেন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনা সচেতনতামূলক একটি বিজ্ঞাপন। তারপর প্রতিদিন সকালে হ্যান্ড মাইকটি হাতে নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েন তিনি। নাটোর শহরের অলি গলিতে, নীচা বাজার, মাদরাসা মোড়ের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে হ্যান্ড মাইকে বাজান সেই রেকর্ডিং। এভাবেই মানুষকে মাস্ক পড়তে, নিয়মিত হাত ধুতে এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিনি তার ফেসবুক পেজে লাইভে মানুষকে করোনা থেকে বাঁচানোর জন্য সচেতন করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যেও তার এমন সচেতনতামুলক কাজ প্রসঙ্গে হাফেজ মানিক পাশা চৌধুরী বলেন, বাসে বাসে বই-খাতা-চকলেট, চাবির রিং বিক্রি করে সংসার চালাতাম। মানুষের মাঝে মিলেমিশেই দিন কাটতো আমার। বর্তমানে করোনাকালে আমার বেচাকেনা বন্ধ। কোনদিন এক বেলা খাবার জোটে, কোনদিন জোটেও না। তাই বলে ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে দিয়ে কি লাভ? আমার প্রতিদিনের প্রচারণায় একজন মানুষও যদি এই মহা বিপদের করোনা থেকে বাঁচে তাহলেই আমার শ্রম সার্থক।

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top